তিন বছর আগে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় এক নারীর টিপ পরা নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ডের ঘটনায় তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই ঘটনায় চাকরি হারানো পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে শেরেবাংলানগর থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। আসামির তালিকায় লতা সমাদ্দারের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক মলয় মালা এবং শোবিজ জগতের ১৬ তারকার নামও আছে।
‘এক টিপে জীবন শেষ’ জানিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের একান্ত আলাপে সেই বরখাস্ত হওয়া কনস্টেবল নাজমুল তারেক বলেন, ‘টিপ থেকে টিপকাণ্ড, এক লাল টিপেই আমার জীবন শেষ। তিন-তিনটে জীবন শেষ! যে ঘটনা ঘটেনি, যার প্রমাণ নেই সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারকারা মনগড়া পোস্ট করে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শুধু সম্মানহানিই করেনি, আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন। সংসদে ১ মিনিটের জন্য খরচ হয় ১৬ লাখ টাকা। সেখানে দেশের উন্নয়নের কথা না বলে আমার কথা বলে ফ্যাসিবাদের গোলামি করতে গিয়ে সংসদের প্রায় এক কোটি টাকা নষ্ট করেছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। নির্দিষ্ট একটি দলকে খুশি করার জন্যই আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারকারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সবাই টিপ পরে ফেসবুকে বিভিন্ন ক্যাপশন দিয়ে বিতর্ক তৈরি করে। যেখানে কিছু ঘটেনি, সেখানে টিপ থেকে টিপকাণ্ড বানিয়েছিলেন এই শোবিজ তারকারা।’
সাবেক এই পুলিশ সদস্য বলেন, ‘সড়কে উল্টো পথে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার জন্য সে সময়ই আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। সেদিন দুর্ঘটনাবশত অভিযোগকারীর গায়ে বাইকের ধাক্কা লাগে। আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে যেতে চাইলে আমার ইউনিফর্মের শোল্ডার ধরে ফেলে দেন। এ ঘটনা ঢাকতে টিপকাণ্ড সাজানো হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে বিষয়টি সাজানো হয়েছিল তার কিছুই ঘটেনি।’
আক্ষেপ করে নাজমুল তারেক বলেন, ‘যেসব অভিনয়শিল্পী আমার সম্পর্কে না জেনেই ফেসবুকে বিভিন্ন ক্যাপশন দিয়ে বিতর্কিত করেছে আমি তো একসময় তাদের নাটক দেখতাম। তারা তো আমার পছন্দের শিল্পী। তারা কি একটিবার চিন্তা করেনি যে এক টিপে কারো জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। আমার পরিবার, চাকরি, পুরো পুলিশ বাহিনীর মান-সম্মান শেষ করে দিয়েছে তারা। আন্তর্জাতিকভাবে পুলিশ বাহিনীর সম্মান ক্ষুণ্ন করেছে।’
তিনি জানান, মামলা হওয়ার খবরে চিত্রনায়ক বাপ্পি চৌধুরী এরই মধ্যে পুরনো পোস্ট ডিলেট করেছেন ফেসবুক ওয়াল থেকে। তবে তার কাছে পোস্টগুলো সংরক্ষিত আছে বলে জানান। প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘ডিলিট করলেই কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যায়? আমার এবং পুলিশ বাহিনীর হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে মনের ভেতরে লুকানো ক্ষোভ জানাতে চান নাজমুল তারেক। সেই সঙ্গে বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে তৎকালীন সরকারের সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করে। আমি এর বিচার চাই। যেসব তারকা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাই। আমার কী অপরাধ ছিল? যাচাই-বাছাই না করে মিডিয়া ট্রায়াল করে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। এখন যতই পোস্ট ডিলেট করুক না কেন, আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। তিন বছর ধরে এসব নিয়ে গবেষণা করেছি। দাড়ি-টুপি থাকলে কেউ জঙ্গি কিংবা জামায়াত হয়ে যায় না। এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষ দলকে খাটো করে অন্য একটি দলকে খুশি করার জন্য এসব করেছে তারকারা।’
চাকরি ফেরত চেয়ে বলেন, ‘প্রথমত আমার চাকরি ফেরত চাই। দ্বিতীয়ত যারা এসব কাণ্ডে জড়িত তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমার বিশ্বাস, এর মাধ্যমে পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরে আসবে।’
সে সময় হেনস্তার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি অবৈধ ও চোরাই, যেটি পাঁচ বছর আগে মিরপুর থেকে চুরি হয়েছিল। তবে নাজমুল তারেক জানিয়েছেন গাড়িটি চুরি করা নয়, নিজের অর্থে কেনা। যারা এসব খবর রটিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
সর্বশেষ তিনি বলেন, ‘আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সম্মানের সঙ্গে বাকি দিনগুলো বাঁচতে চাই। যেটি আমি করিনি, বলিনি, সেটিই তখন প্রতিষ্ঠিত করার অপরাধে জড়িতদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার অনুরোধ রইল। বহির্বিশ্বে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে, এর বিচার চাই।’
টিপকাণ্ডে অন্যান্য আসামির মধ্যে রয়েছেন অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা, অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন, সাজু খাদেম, প্রাণ রায়, সাইমন সাদিক, মনোজ প্রামাণিক, স্বাধীন খসরু, চয়নিকা চৌধুরী, আশনা হাবিব ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতি, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সানাইরা দেবী শানু, নাজনীন নাহার চুমকি, সুষমা সরকার ও কুসুম সিকদার। শোবিজের ‘আরও কয়েকজনকে’ আসামি করা হয়েছে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে।
২০২২ সালের এপ্রিলে কপালে টিপ পরা নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় হেনস্তার অভিযোগ তোলেন তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। তার এই অভিযোগ প্রকাশ পেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হয়।
হেনস্তাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংসদে দাবি তোলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। ওই সময় শোবিজের আরও অনেক তারকা প্রতিবাদে শামিল হন। জড়িত পুলিশ সদস্যের বিচার দাবিতে মানববন্ধনও হয়। এসব ঘটনার জেরে ওই সময় চাকরি হারান নাজমুল তারেক।
নাজমুল তারেক তার মামলায় অভিযোগ করেছেন, ২০২২ সালের ওই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের সময় এসব তারকা ইচ্ছা করে পুলিশের মানহানি ঘটিয়েছেন। তারা সামাজিক মাধ্যমে ছবি ও বক্তব্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, যার ফলে তার পেশাগত ও সামাজিক জীবনের ‘মারাত্মক ক্ষতি’ হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :