রাষ্ট্রীয় খরচ কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে এবং সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে আসছে সরকার। অবশ্য নিরুৎসাহিত করা সরকারি পরিপত্র প্রতিপালনের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখাতে পারছেন না সরকারি কর্মকর্তারা। ছলে বলে কৌশলে এবং প্রশিক্ষণের নামে সরকারি আদেশ (জিও) বাগিয়ে বিদেশ সফর বিলাস অব্যাহত রেখেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্ত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা।
ভিসা নিশ্চিতে পরিবারের সদস্যরাও জিও’তে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি ভ্রমণ বিলাসের বৈধতা দিতে বিদেশ ভ্রমণের শর্ত রেখেই চুক্তি করা হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে। পুরো বিষয়টিকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সংঘাত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও সচেতন থেকে শুধু বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চিতে নীতিমালা প্রণয়নের কথা জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব।
২০২২ সালে প্রথমবার এবং সবশেষ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক মাস আগেও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করতে পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগ। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই জারিকৃত ওই পরিপত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান; মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কয়েকটি খাতে টাকা খরচে মিতব্যয়ী হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমানোর সিদ্ধান্ত।
পরিপত্র অনুসারে, সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ, ওয়ার্কশপ-সেমিনারে অংশ নেওয়া বন্ধ থাকবে। তবে অতি জরুরি বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছিল। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি টাকায় ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের পক্ষ থেকে স্কলারশিপ-ফেলোশিপের আওতায় বিদেশি অর্থে মাস্টার ও পিএইচডি কোর্সে পড়ার জন্য বিদেশে যাওয়া যাবে। বিদেশি সরকার, প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীর আমন্ত্রণে ও সম্পূর্ণ অর্থায়নে আয়োজিত বিদেশে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া যাবে।
গত ৯ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত এক পরিপত্রে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধীনস্থ অধিদপ্তর বা সংস্থাপ্রধানদের একান্ত অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণে বিরত থাকতে বলা হয়। পাশাপাশি কেনাকাটা বা ফ্যাক্টরি অ্যাকসেপ্ট্যান্স টেস্টের (এফএটি) ক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞদের প্রেরণের বিবেচনা, সরকারি অর্থে কম প্রয়োজনীয় ভ্রমণ অবশ্যই পরিহার করা, দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ছুটি পরিহার এবং বিদেশ ভ্রমণে প্রস্তাবিত কর্মকর্তার পূর্ববর্তী এক বছরের বিদেশ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে।
এরপর গত ২৩ মার্চ সরকারি কর্মকর্তাদের ঠিকাদার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। পাশাপাশি জরুরি কারণ ছাড়া উপদেষ্টা বা সিনিয়র সচিব ও সচিবদের একান্ত সচিব বা সহকারী একান্ত সচিবদের সহযাত্রী হিসেবে বিদেশে ভ্রমণ এবং সরকারিভাবে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের স্বামী/স্ত্রী বা সন্তানদের সফরসঙ্গী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। তবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্ত সংস্থা, দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের মাঝে বিদেশ ভ্রমণের বদলে এসব পরিপত্র প্রতিপালনে নিরুৎসাহ পরিলক্ষিত হয়।
আইসিটি বিভাগ: ‘২৬তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড ২০২৪’-এ অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান সফর করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন আইসিটি অধিদপ্তরের তিন কর্মকর্তা। তারা হলেনÑ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ খায়রুজ্জামান, প্রোগ্রামার আব্দুল্লাহ বিন সালাম এবং সহকারী নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী জুনায়েদ সিদ্দিকী। গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মকর্তাদের এই সফরের খরচ বহন করে আইসিটি অধিদপ্তর। এর পরের মাসে ৭ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ‘বিমসটেক ডিজিটাল কনক্লেভ-২০২৫’ এ অংশ নিতে দেশটিতে সফর করেন দুই কর্মকর্তা। তারা হলেনÑ সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাবেক একান্ত সচিব (পিএস) আলাওল কবির এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এটুআই প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট লিড আব্দুল্লাহ আল ফাহিম। অনুষ্ঠানটিতে উপদেষ্টা না গেলেও, গিয়েছেন তার পিএস। এই সফরের প্রায় এক মাস পরই বদলি হয় আলাওল কবিরের।
এই দুই কর্মকর্তার ভ্রমণের খরচ বহন করে তাদের স্ব স্ব সংস্থা অর্থাৎ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ (পিটিডি) এবং আইসিটি বিভাগ। গত ৩ থেকে ৬ মার্চ আয়োজিত ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস-২০২৫’ এ অংশ নিতে স্পেনের বার্সালোনা সফর করেন আইসিটি বিভাগের উপসচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ সাইফুল হাসান। গত ১১ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত জারি করা জিও’র স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তাও তিনি। জিও পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তার নামও ছিল সেখানে। তবে অনুষ্ঠানের আগেই নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করলে, শেষ পর্যন্ত আর স্পেনে যাননি বলে রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেন তাদের একজন। এই সফরের অর্থ দিয়েছে চীনভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজিস।
সপ্তম আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের একটি সভা, পৃথম একটি সেমিনার এবং হুয়াওয়ে একাডেমি পরিদর্শনে ফিলিপাইনের ম্যানিলা সফর করেন আইসিটি বিভাগের যুগ্মসচিব ও জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির (এনসিএসএ) মহাপরিচালক ড. তৈয়বুর রহমান। জিও অনুযায়ী তার সফরসঙ্গী ছিলেন সহধর্মিণী সুলতানা আক্তার। সহধর্মিণীর খরচ তৈয়বুর রহমান বহন করলেও, তৈয়বুর রহমানের খরচ বহন করেছে সরকারি সংস্থা এনসিএসএ। তৈয়বুর রহমানের নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগ এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি দল আগামী ২৩ থেকে ২৫ এপ্রিল জাপানের রাজধানী টোকিও সফর করবেন।
এ-সংক্রান্ত জিও অনুযায়ী, এই দলে তৈয়বুর রহমানের সাথে রয়েছেন আইসিটি বিভাগের দুই উপসচিব মোহাম্মদ ইউসুফ ও এএসএম লুকমান, হাইটেক পার্কের পরিচালক ও উপসচিব এস এম ফরিদ উদ্দিন, চলতি দায়িত্বের দুই উপপরিচালক শফিক উদ্দিন ভুঁইয়া ও গোলাম কিবরিয়া এবং সহকারী পরিচালক রকিবুল হাসান। এখানেও নিজ সহধর্মিণী এবং কন্যাকে সফরসঙ্গী করে গত ২৩ মার্চ জিও দিয়েছে আইসিটি বিভাগ। অথচ ২৩ মার্চ পরিবারের সদস্যদের সরকারি সফরে অন্তর্ভুক্ত না করার নির্দেশনাসংক্রান্ত চিঠি দিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে সহধর্মিণী এবং কন্যাকে বাদ দিয়েই নতুন করে জিও দেওয়া হয়েছে বলে রূপালী বাংলাদেশের কাছে দাবি করেন তৈয়বুর।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ: বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘ইন্টারনেট প্রটোকল নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপেনশন’ তথা আইপি প্রকল্পের আওতাধীন অস্ট্রিয়ায় ‘নির্বাহী সফর’ এ অংশ নেন চার কর্মকর্তা। বিটিসিএলের নিয়মিত ঠিকাদার চীনভিত্তিক আরেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেডটিই করপোরেশনের অর্থে ভ্রমণকারী এই চার কর্মকর্তা হলেন- ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (পিটিডি) সচিব মুশফিকুর রহমান, তার একান্ত সচিব (উপসচিব) মোকলেছুর রহমান, বিটিসিলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন এবং আইপি প্রকল্পের পরিচালক মামুনুর রশীদ। গত বছরের ২০ থেকে ২৮ ডিসেম্বর এই সফর আয়োজিত হয়। এদের মধ্যে দুজন কর্মকর্তা সচিব মুশফিকুর রহমান এবং তার একান্ত সচিব মুকলেছুর রহমান গত বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের জন্যও স্পেন সফর করেন। তবে এবার মুকলেছুরের খরচ বহন করে জেডটিই এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত হুয়াওয়ে।
মুকলেছুর ছাড়াও স্পেন সফরের সরকারি অনুমতি পেয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকের এমডি নুরুল মাবুদ চৌধুরী, অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক শিরিন আক্তার এবং সেসময় আইসিটি বিভাগের পলিসি এডভাইজারের দায়িত্বে থাকা ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। তবে অনুসন্ধান বলছে, ঠিকাদারের অর্থে এই সফরে অংশ নেননি ফয়েজ তৈয়্যব। বিটিসিএল এর একই আইপি প্রকল্পের আওতায় জেডটিই’র অর্থে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সিঙ্গাপুর এবং চায়না সফর করেন আরও চার কর্মকর্তা। তারা হলেন- বিটিসিএলের তৎকালীন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল করিম, পিটিডি’র উপসচিব রফিকুল ইসলাম, প্রকল্পের উপ-পরিচালক শাহিন ইকবাল আখি এবং ব্যবস্থাপক আনোয়ার পারভেজ।
ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরেও অব্যাহত রাখে জেডটিই এবং হুয়াওয়ে। টেলিটকের একটি প্রকল্পের কাজের অধীন কারখানা পরিদর্শন বা টেস্টের নামে ১৮ থেকে ২৫ জানুয়ারি প্রকল্পের পরিচালক এ এম আখতারুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস উইংয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক খলিল উর রহমানকে চীন সফর করায় হুয়াওয়ে। আর বিটিআরসির রেভিনিউ বাজেটের বৈদেশিক সফর খাত থেকে পিটিডির সচিব মুশফিকুর রহমানের সাথে স্পেনের বার্সালোনা সফর করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। অবশ্য টেলিটকের তিন কর্মকর্তাকে এই অনুষ্ঠানে নেয় জেডটিই। তারা হলেন- মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম (ক্রয়) এবং খাইরুল আমিন (অর্থ ও হিসাব)।
দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিসের অর্থে ১৮ থেকে ২০ মার্চ সিঙ্গাপুর সফর করেন বিটিসিএলের দুই ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান এবং শাবানাজ জেরীন খান। আইপি প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজের আওতায় ‘অপারেশনাল অ্যাকসেপ্ট্যান্স টেস্ট’ এর নামে এই সফর করেন তারা। বিটিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক (ক্রয়) এস ওয়াজেদ আলী এই সফরের অনুমতি পেয়েছিলেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ওই সফরে যাননি।
বিটিআরসি: ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের (আইটিইউ) একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের জেনেভা সফর করেন বিটিআরসির সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান হিরু। হিরুর এই সফরের বিমান খরচ বহন করে বিটিআরসি। দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র অর্থে মালয়েশিয়া সফর করেন বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের মহাপরিচালক শফিউল আলম পারভেজ, এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিরেক্টরেটের পরিচালক মোহাম্মদ নূরন্নবী এবং স্পেকট্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক মিন্টু প্রাং।
‘এপ্রিকট ২০২৫’ এ অংশ নিতে ১৯ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া অবস্থান করেন তারা। বিটিআরসির চার কর্মকর্তাকে স্পেনের বার্সালোনায় নিয়ে যায় হুয়াওয়ে। তারা হলেন- স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মাহমুদ হোসেন, লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু, সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের ফারহান আলম এবং চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক ইশতিয়াক আরিফ।
বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে আরেক তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছেন কমিশনের প্রশাসন বিভাগের উপ-পরিচালক মিরাজুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইক্যান এর অর্থায়নে আরেক উপ-পরিচালক পদমর্যাদার সাথে ৮ থেকে ১৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল সফরে অনুমতি পেয়েছিলেন মিরাজুল। ঐ দুই কর্মকর্তার সফরে ভিন্ন দুইটি জিও দেয় বিটিআরসি। গত ১৯ জানুয়ারি জারি করা ইস্যুতে দেখা যায়, মিরাজুল ইসলামের সফরের অর্থ বহন করবে বিটিআরসি। তবে এক মাসেরও বেশি সময় পর ২৭ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত জিও অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিজেই নিজের খরচ বহন করবে মিরাজুল।
উভয় জিও’তেই ঐ দুই কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে দায়িত্ব পালন হিসেবে দেখানো হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, আইক্যানের সম্মেলনে না বরং স্ত্রী-সন্তানদের সাথে দেখা করতেই যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি আইক্যান সম্মেলনেও নামমাত্র উপস্থিত ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিশ্চিত করতেই তদবির করে সরকারি অর্থায়ন উল্লেখিত জিও নেন মিরাজুল। তবে কমিশনের অর্থ বিভাগের আপত্তির মুখে পৃথক জিও’টি ইস্যু করা হয়। যদিও পূর্বের জিও বাতিল মর্মে নতুন জিও’তে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মিরাজুল ইসলাম।
ঠিকাদারের অর্থে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরকে ‘স্বার্থের সংঘাত’ হিসেবে দেখছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে ত্রিমাত্রিক অনিয়মের আশঙ্কা করে রূপালী বাংলাদেশকে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঠিকাদারের অর্থে বিদেশ ভ্রমণে সরাসরি স্বার্থের সংঘাত হয়। দ্বিতীয়ত, সফরকে বৈধতা দিতে চুক্তির মধ্যে বিদেশ সফরের বিষয় রাখা শুভংকরের ফাঁকি, যেটা তারা আমলে নিচ্ছে না। বুঝতে হবে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যারিটি করছে না বা লাভের অংশ থেকে সফর ব্যয় দিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণের পেছনে ব্যয় করা অর্থ আমাদের কাছ থেকেই মুনাফা হিসেবে আদায় করে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা (ঠিকাদারদের সাথে) পরস্পর যোগসাজশে চুক্তিতে এসব শর্ত দেয়। এতে প্রকল্পের টাকা যেমন লুটপাত হয় তেমনি বিদেশ সফর বাবদ কর্মকর্তাদের আয় হয়। তৃতীয়ত, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সরকারি অর্থে বিদেশ সফর হচ্ছে। সরকার বলছে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ধরনের বিদেশ সফর অগ্রহণযোগ্য।
টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থে বিটিআরসির কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর প্রসঙ্গে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে (বিটিআরসির) যে মৌলিক ভূমিকা, সেটা পালনে আবারও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে; এটা খুবই স্বাভাবিক। কর্তৃত্ববাদের সময়ে আমলারা যা চেয়েছে সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে দেশবাসী আশা করে। সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু একদিকে আমলারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করছেন, আরেকদিকে সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের যে সুযোগ এসেছে, সেটিকে পদদলিত করার চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য।
সরকারের বা ঠিকাদারের অর্থে বিদেশ যাওয়া বলে মনে করেন খোদ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ তৈয়্যব। বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন হচ্ছে উল্লেখ করে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, স্পেনে মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে টেলিযোগাযোগের বিশ্বের অংশীদাররা আধুনিক প্রযুক্তি তুলে ধরেন। এখানে যাওয়াটা সমীচিন, সবাই যায়। আমি নিজেই যেহেতু বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, তাই অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর এড়িয়ে চলি। সরকারের বা ঠিকাদারের অর্থায়নে যাওয়া ঠিক না। উন্নয়ন সহযোগীর অর্থে কেউ বিদেশ গেলে ভিন্ন কথা। আগামী দিনে এ বিষয়ে আরও সচেতন থাকব। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পাশাপাশি একটি নীতিমালা নিচ্ছি যেখানে অবদান রাখতে পারেন এমন বিশেষজ্ঞদের বিদেশ পাঠাব।
আপনার মতামত লিখুন :