ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

তিতাসের অবৈধ সংযোগ

৭ মাসে বিচ্ছিন্ন ২৯ হাজার সংযোগ বাতিল ৬৭ হাজার বার্নার

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২৫, ১১:৪৪ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দেশজুড়ে তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগের ছড়াছড়ি। দীর্ঘদিন যাবত বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো পদক্ষেপ না নিলেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চালানো হচ্ছে নিয়মিত অভিযান। ফল হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৩২টি অবৈধ সংযোগ। বাতিল করা হয়েছে ৬৭ হাজার ২১২টি বার্নার।

কাটা হয়েছে ১৪৪ কিলোমিটার পাইপলাইন। তবুও থামছে না নতুন সংযোগ। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নতুন করে অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে সুবিধা আদায় করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এমনকি এদের দাপটে অভিযানও হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন তিতাসের কর্মীরা। এসব অবৈধ সংযোগের কারণে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। ঘটছে নানা দুর্ঘটনাও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও থেমে নেই অবৈধ সংযোগের ব্যবহার। দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রাহকরা অনুমোদন ছাড়া এসব লাইন ব্যবহার করছে প্রতিনিয়ত। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও আবার একইভাবে সংযোগ পেয়ে যান তারা। এসব অবৈধ সংযোগের বিষয়ে সরকার কঠোর থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম।

বিতরণ সংস্থা তিতাস জানিয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২৩০টি শিল্প, ১৫৫টি বাণিজ্যিক ও ২৯ হাজার ২৩২টি আবাসিকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২৯ হাজার ৬১৭টি অবৈধ সংযোগ। এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের ফলে দৈনিক প্রায় ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এসব অবৈধ সংযোগের বেশির ভাগই তিতাস গ্যাসের অধীন কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশান, ময়মনসিংহ, মেঘনাঘাট ও নরসিংদী এলাকায়।

অভিযোগ পাওয়া যায়, এসব এলাকার প্রভাবশালীদের দাপটে পাওয়া গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলেও আসছে নানা রকমের বাধা। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে হামলারও শিকার অনেক কর্মী। চলতি বছরের শুরুতেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের অতর্কিত হামলায় গুরুতর আহত হন তিতাস গ্যাসের নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক বিপণন বিভাগ, সোনারগাঁর উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন। এ ছাড়া হামলায় ওই অফিসের একজন কর্মচারী, সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী টিমের ২ শ্রমিক এমনকি কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হন।

ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহত প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন জানান, আমরা জেলা প্রশাসন নারায়ণগঞ্জকে অবহিত করেই ফজলে ওয়াহিদ, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের নেতৃত্বে অভিযান চালাই। অভিযানে মৈষটেক এলাকায় প্রায় ১ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এতে আনুমানিক ২০০ বাড়ির প্রায় ২০০টি আবাসিক চুলা বিচ্ছিন্ন এবং প্রায় ১০০ ফিট এম.এস ও ১৫০ ফিট পিভিসি পাইপ উচ্ছেদ করা হয়। মৈষটেক এলাকায় অভিযান শেষে মিরেরটেক বাজার সংলগ্ন ২ ইঞ্চি ডায়াবিশিষ্ট অবৈধ লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে কিছু লোক অতর্কিত আমাদের ওপর হামলা চালায়। এটিই প্রথম নয়, এর আগেও এসব এলাকায় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে হামলার শিকার হতে হয়েছে অভিযান পরিচালনাকারীদের।

হটস্পট নারায়ণগঞ্জ: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগের হটস্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা। অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যেকোনো এলাকায় মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। কোথাও দুই ইঞ্চি আবার কোথাও চার ইঞ্চির সারি সারি পাইপ। নতুন ভবন নির্মাণেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্রায় প্রতি বাড়িতেই অবৈধভাবে ব্যবহার হচ্ছে তিতাস গ্যাস। গত এক দশক ধরে সরকার সারা দেশে আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখলেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অন্তত ত্রিশ হাজার অবৈধ সংযোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক কর্মকর্তা জানান, রূপগঞ্জ উপজেলায় ত্রিশটি পয়েন্টে ত্রিশ হাজারের অধিক অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করে তিন দফায় অভিযান চালিয়ে পনেরো হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তিতাস কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে লাখ টাকার বাণিজ্য কেরাণীগঞ্জে: নারায়গঞ্জের মতোই অবৈধ গ্যাস সংযোগের আরেকটি হটস্পট রাজধানীর কেরানীগঞ্জ। অবৈধ সংযোগ বাণিজ্যে এই এলাকায় একটি মহল লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মাসিক টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কেরানীগঞ্জে তিতাস কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে মাসিক বিল পরিশোধের নামে টাকা উঠাচ্ছে ঠিকাদাররা।

আটিবাজার, খোলামরা, ভাওয়াল, নেকরোজবাগ, কালিন্দি, বরিশুরসহ অনেক এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। ওই এলাকাগুলোতে বেশির ভাগই অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। এসব ভবন থেকে অতিরিক্ত চুলা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করছে নামধারী ঠিকাদাররা। তিতাসের কর্মকর্তাদের নাম বলে এসব টাকা তোলা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন গ্রাহক জানান, তিতাস গ্যাসের কতিপয় ঠিকাদার ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিনিময়ে আমাদের অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে থাকে। আমরা এলাকার দালালদের মাধ্যমে প্রতিমাসে প্রচলিত সরকারি রেটে নিয়মিত ‘বিল’ আদায় করছি। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও তা আবার গোপনে পুনঃসংযোগ দিয়ে যায়।

অভিযানেও থামছে না সাভারে অবৈধ সংযোগ:  শিল্পাঞ্চল হিসেবেই বেশি পরিচিত সাভার। এই অঞ্চলে আবাসিকের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানায়ও মিলছে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ। অভিযান পরিচালনা করতে করতে বিরক্তও হন দায়িত্বশীলরা। সম্প্রতি সাভারে পাঁচ শতাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা আদায় করেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এসব অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন রায়, এক এলাকায় একদিন গিয়ে লাইন বিচ্ছিন্ন করে আসলেও পরেরদিন আবার খবর পাওয়া যায় একই এলাকায় আরেক জায়গায় অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এভাবে প্রতিদিনই প্রায় আমাদের অভিযান চালাতে হচ্ছে।

মিরপুর, টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়ায়: অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ির রয়েছে মিরপুর, টঙ্গী, গাজীপুর এবং আশুলিয়া এলাকায়ও। এসব এলাকার অনেক শিল্পকারখানাতেই রয়েছে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ। সম্প্রতি মেঢাবিবি-৪  তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি পিএলসির আওতাধীন মিরপুর জোনের কালশী, ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জ্বালানি বিভাগ। এ সময় ডেনিমিক্স ওয়াশিং, কালশি, সেকশন-১২; আলহামদুলিল্লাহ ওয়াশিং, ব্লক-কে, রোড-এন/২, ইস্টার্ন হাউজিং এবং নামবিহীন ওয়াশিং কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। একই সময় ২০৮ ফুট জিআই পাইপ, ১২০ ফুট হোসপাইপ, ১টি রেগুলেটর ও ১টি ভালভ জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ডেনিমিক্স ওয়াশিংয়ের ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুনকে বাংলাদেশ গ্যাস আইন, ২০১০ এর ১২ (১) ধারায় এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয় এবং তাৎক্ষণিক তা আদায় করা হয়।

যতদিন অবৈধ সংযোগ ততদিন অভিযান: বিগত সরকারের আমলে যেসব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর একটিও থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দেশ লম্বা একটা সময় স্বৈরশাসকের অধীন ছিল। সেই সময় বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক নেতারা তাদের দাপটে এবং নিজেদের আখের গোছাতে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিয়েছে। বিনিময়ে লুটে নিয়েছে সরকারের লাখ লাখ টাকা। আমরা এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নিয়মিত অভিযান শুরু করেছি। সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হওয়া অবৈধ সংযোগের বদৌলতে আমাদের রাজস্বও বেড়েছে। যতদিন একটিও অবৈধ সংযোগ থাকবে ততদিন আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।