ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

বিএনপির প্রতিশ্রুতি চ্যালেঞ্জিং মনে করেন বিশেষজ্ঞরা

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৫, ১১:১৬ পিএম
ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

বিএনপি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে প্রথম বছরে ১ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি সরকার গঠন করার ৯ বছরের মধ্যে স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ১ ট্রিলিয়ন ডলারে নির্ধারণ করা হবে বলে দলীয় নীতিনির্ধারণী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

শুধু তাই নয়, দলটি জনগণের ঘাড় থেকে বাড়তি করের লাগাম টেনে ধরে মানুষের মন থেকে করের ভয় দূর করতে চায়। তবে তাদের চাওয়া বা প্রতিশ্রুতিকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগাতে অতিতের সরকারগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। সরকারে যে দলই থাকে, সেই দল দুর্নীতির মধ্যে ডুবে থাকে।

ফলে সাধারণ জনগণের মঙ্গলের কথা, দেশের উন্নয়নের কথা ভুলে যায়। বিএনপি যে পদক্ষেপের কথা বলেছে, সেটা খুবই ভালো, তবে তা বাস্তবায়ন করা বেশ চ্যালেঞ্জ মনে করছেন তারা।

বিএনপি বলছে, তারা সরকার গঠন করতে পারলে দেশের মানবসম্পদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া, প্রকৃত প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানোর জন্য বিএনপি অতীতের চেয়েও ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে চাইছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা জনসম্মুখে আটটি প্রস্তাবের কথা তুলে ধরছি।

এগুলো হলো বিডাকে কার্যকর করা, ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট বিধির আধুনিকীকরণ, বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ধরনের সেবা চালু করা, স্বয়ংক্রিয় মুনাফা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা। স্থানীয়ভাবে দক্ষ জনশক্তির ব্যবস্থা করা।

বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রকৃত প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানো।

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, সরকার গঠন করতে পারলে দেশের মানবসম্পদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া, প্রকৃত প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানোর জন্য বিএনপি অতীতের চেয়েও ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে চায়।

তিনি জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করবেন। ঐক্যই ভবিষ্যৎ জাতীয় উন্নয়নের সোপান, এফডিআই আকৃষ্ট করতে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার আইন করেছিল এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সরকারগুলোর বিনিয়োগবান্ধব নীতি ছিল। 

সেটার দিকে নজর দেওয়া হবে। ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে প্রথম ১৮ মাসে বিএনপি ১ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে।

কর্মসংস্থান নিয়ে তাদের বিশাল পরিকল্পনা আছে। এ ক্ষেত্রে টার্গেট তরুণ প্রজন্ম, অর্থাৎ জেন-জি। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তাদের বলা হয়ে থাকে জেন-জি বা জেনারেশন জেড। বর্তমানে এই প্রজন্মের সদস্যদের বয়স ১৩ থেকে ২৮ বছর। তাদের কাজে লাগাবে দলটি।’

কর্মসংস্থানের যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলবে বিএনপি: সম্প্রতি বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে জানানো হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে প্রথম ১৮ মাসে ১ কোটি কর্মসংস্থান বা চাকরির ব্যবস্থা করবে।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)/মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে বিএনপি।

২০৩৪ সালে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ১ ট্রিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে বিএনপি। জনগণের ঘাড় থেকে বাড়তি করের লাগাম টেনে ধরা, মানুষের মন থেকে করের ভয় দূর করে কীভাবে কর আহরণ বাড়ানো যায়, তা নিয়েও কাজ করতে চায় বিএনপি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি অনেকগুলো খাত খুলে দেবে।  এর মধ্যে আইটি, কৃষি ও তৈরি পোশাক খাতে বড় কর্মসংস্থানের আশা করছে।

এ ছাড়া পর্যটন, প্রবাসীসহ দেশের বিভিন্ন খাতে এবং বিদেশেও অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। আর কর্মসংস্থানের বিষয়টি নির্বাচনি ইশতেহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে।

এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপির আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের সময়ে বড় বড় মেগা প্রজেক্টের নাম দিয়ে যে প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছিল, সেই প্রবৃদ্ধি ছিল জবলেস গ্রোথ অর্থাৎ, কর্মসংস্থানবিহীন একটি প্রবৃদ্ধি। সেটার সুফল দেশের জনগণ পায়নি, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়নি।

কিন্তু বিএনপির মডেল হবে। প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণকে পেতে হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে হবে এবং সেই ধরনের বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করবে বিএনপি।

যেখানে জনগণের কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল যাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। সেই বিনিয়োগ হতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দক্ষতা তৈরি ও দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা। কর্মসংস্থানের যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। সেটি সম্ভব। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে।

তরুণ প্রজন্মকে কর্মক্ষম করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও সম্ভব হবে:  বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কর্মসংস্থান নিয়ে বিএনপির একটি বিশাল পরিকল্পনা আছে।

আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যদি আমরা কর্মক্ষম করতে না পারি, কর্মোপযোগী করতে না পারি, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও সম্ভব হবে না। আমাদের জেন-জি হলো বড় টার্গেট।

তারা জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে, যা আত্মকর্মসংস্থান, সরকারি-বেসরকারি, বিদেশি কর্মসংস্থান সবকিছু মিলিয়ে। অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে হলে এটি করতে হবে। এ নিয়ে বিএনপি এরই মধ্যে কাজও করছে।

তিনি বলেন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান যা আছে বিএনপির সময়েই। বিএনপি সরকারকে বলা হয়েছে ‘ইমার্জিং টাইগার’। তারপর সরকার পরিবর্তন হলে সব ধ্বংস করা হলো।

পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আত্মকর্মসংস্থানসহ অনেক আইটি সেক্টরে তরুণ জেন-জির জন্য আমাদের একটা বড় কর্মসূচি আছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়ন। এর মাধ্যমে আমরা আইটি সেক্টরে একটা বিরাট কর্মসংস্থান আশা করছি। আর বিদেশে কর্মসংস্থানের একটা বিরাট সুযোগ আছে।

‘দেশের মধ্যে আমরা বেসরকারি সেক্টরকে আরেকটু সমৃদ্ধ করতে চাইছি। দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তার মাধ্যমে আশা করছি বড় বিনিয়োগ হবে। আসলে বিএনপির সময়েই বেসরকারি সেক্টর বড় করেছি। বেসরকারি সেক্টর দিয়েই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এটা তো বিএনপিরই উদ্যোগ। পুরো অর্থনৈতিক কর্মসূচিই হচ্ছে বেসরকারি সেক্টর। সেখানে প্রচুর সম্ভাবনা আছে, যা কাজে লাগাতে পারি।

তারপর অনেক পণ্য ও সেবা আছে, যেগুলো তদারকির আওতায় আনা হয়নি, স্থিতিশীল নয়; এগুলোকে স্থিতিশীল করলে আমাদের বড় ধরনের একটা কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে। কৃষি খাতেও প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। বিদেশেও অনেক সুযোগ হবে।

ভাষাগত দক্ষতা তৈরি করা গেলে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। সবকিছু মিলিয়ে অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের কাজ হচ্ছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, চাকরি উপযোগী করা। বিএনপির পরিকল্পনায় সব প্যাকেজ আছে।’

রাজনৈতিক ও বিএনপির গবেষণা উইং বিএনআরসির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু বলেছেন, অর্থনীতির উন্নতি তিনভাবে হতে পারে।

একটা হচ্ছে টাকা ছাপিয়ে দেশ চালানো। আবার একটা মডেল আছে ঋণ অথবা ঋণের টাকা ছাপিয়ে দেশ চালানো। তৃতীয়টা হচ্ছে, বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বিনিয়োগের মাধ্যমেই যে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে, সেই অর্থনীতি টেকসই হয়। বিএনপি সব সময় তৃতীয় অপশন নিয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়ালে কর্মসংস্থান অনেক বাড়বে।

ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের সময়ে প্রচুর ঋণ করেছে, টাকা ছাপিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের যেন আকৃষ্ট করতে পারি, পরিবেশটা দিতে পারি। সারা বাংলাদেশে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগ করবে। সেটি হলে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

এটি কারখানা বলেন, আইটি সেক্টর বলেন আর বিভিন্ন সেক্টর বলেন। তাহলে বিভিন্ন জেনারেশন জেন-জি বলেন, জেন-এক্স বলেনÑ প্রতিটি সেক্টরে তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে।

‘উৎপাদন সেক্টরে গার্মেন্টসের পাশাপাশি নতুন নতুন সেক্টরকে সংযুক্ত করা হবে। আইটি সেক্টরে আরও উন্নতি করা হবে। প্রতিটি সেক্টরে যখন উন্নতি হবে, তখন কর্মসংস্থান বাড়বে। আমাদের বড় একটি জেনারেশনের বয়স ১৫ থেকে ২৯-এর মধ্যে। এদের সংখ্যা ২৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৬০ লাখ।

তাদের যদি আমাদের ধরতে হয়, তাহলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জেন-জিদের দক্ষতা যদি আহরণ করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিএনপি এরই মধ্যে বলেছে, বিনিয়োগবান্ধব পলিসি করবে এবং দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যা যা করা দরকার, সেই পরিবেশ তৈরি করবে।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের এক অধ্যাপক ও অর্থনৈতিক বিভোগের আরেক অধ্যাপক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা বিগত দিনে দেখেছি, আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক কল্যাণকর পদক্ষেপের কথা জনগণকে জানিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তারা সেটা পূরণ করতে পারেনি। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং দেশ অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে গড়ে উঠবে।

তাদের এই পদক্ষেপ বেশ ভালো হলেও সত্যি এটা যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে তারা জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষয়টি ভুলে যায় এবং তারা নিজেদের আখের গোছাতে থাকে, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।

এজন্য বিএনপির পদক্ষেপ বাস্তবায়নের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে দেশের সাধারণ মানুষ।