আর্থনা (আমাদের পৃথিবী) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে কাল সোমবার কাতারের উদ্দেশে যাত্রা করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ২২ ও ২৩ এপ্রিল কাতার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে।
এতে স্পিকার হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আয়োজকদের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর বাইরেও দেশটির আমিরের সঙ্গে পার্শ্ব বৈঠকের কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে দেশটি থেকে বাড়তি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য চূড়ান্ত আলোচনা হতে পারে।
বার্ষিক আরও অন্তত দুই মিলিয়ন টন এলএনজি আনার জন্য প্রাথমিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে বর্তমানে দেশে চলমান গ্যাস সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে যখন জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছিল তখন চুক্তির বাইরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস তথা এলএনজি দিতে রাজি হয়নি দেশটি। তবে বিগত সরকারের আমল থেকেই দেশটি থেকে চুক্তির বাইরেও বার্ষিক আরও ২ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছিল। দুই দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। তবে দুই ২ মিলিয়ন নয়, তখন দেড় মিলিয়ন টন গ্যাস দিতে রাজি হয় দেশটি। যা ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে। প্রথম বছরে ১২ কার্গো, পরের বছর ২৪ কার্গো এমন করে ধাপে ধাপে আসবে ওই গ্যাস।
এর বাইরেও বর্তমানে দেশটি থেকে পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী বছরে ৪০ কার্গো এলএনজি আমদানি করছে। তাও শিল্পায়নের প্রভাবে দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। অনেক শিল্পকারখানা গ্যাস সংকটে উৎপাদন করতে পারছে না। তাই সরকার বাড়তি গ্যাসের সন্ধান করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় খুবই শিগগিরই ব্রুনাইয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে এলএনজি আমদানিতে। আর প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরকালীন সময়ে দেশটি থেকে চুক্তির বাইরেও এলএনজি আনা যায় কি না এ নিয়ে হবে আলোচনা।
এ তথ্য নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সব ধরনের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বাড়তি জ্বালানি যোগান দিয়ে দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করতে গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে।
প্রয়োজনীয় জ্বালানি সঠিক সময়ে সরবরাহের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে আমাদের আরও জ্বালানির প্রয়োজন। এর জন্য দেশীয় কূপ খননে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এসব কূপে নতুন করে গ্যাস পাওয়া পর্যন্ত সময়টা তো আমাদের চলতে হবে। এর জন্যই আমরা খুব শিগগিরই ব্রুনাইয়ের সঙ্গে এলএনজি আমদানির একটি চুক্তি করতে যাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরের সময় দেশটি থেকে বাড়তি গ্যাস আনা যায় কি না. এ নিয়ে আলোচনা হবে। যদি তাদের সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে আমরা নতুন করে চুক্তি করতে উদ্যোগ নেব।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কয়েক বছর ধরে এলএনজির দাম বেড়েছে। ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে পেট্রোলিয়াম পণ্য কিনতে চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। তবে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে দামের উঠানামা করলেও দেশের আর্থিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে তীব্র দাপদাহ, নতুন নতুন শিল্পায়ন প্রভৃতি কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস। এক্ষেত্রে কাতার থেকে পরে মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে আরও জ্বালানি আমদানি করা গেলে সংকট কিছুটা হলেও কাটতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বার্ষিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কম খরচে জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই বছর ওমান, ব্রুনাই, সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ব্যাহত হয় আমদানি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা জ্বালানির বিকল্প বাজার দীর্ঘদিন থেকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু উপযুক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। কাতার আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু। ইতোমধ্যেই দেশটি থেকে আমরা জ্বালানি আমদানি করছি। এর বাইরেও যদি আরও আনতে পারি তাহলে চলমান সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
দেশের গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সংকটকালীন সময়ের আগে সরবরাহ করা হতো ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে এতদিন সরবরাহ হচ্ছিল ২৭৫ থেকে ২৮০ মিলিয়ন গ্যাস। যার মধ্যে ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসছে দেশীয় উৎস থেকে আর আমদানি করা এলএনজি যোগ হচ্ছে ৪৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
যা কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে আসছে। মাঝখানে চাহিদার ৭০ থেকে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আগে স্পট মার্কেট থেকে কেনা হলেও মাঝখানে উচ্চ মূল্যের কারণে কেনা বন্ধ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে চাহিদার চাইতে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। এর পরেই কাতার থেকে বাড়তি এলএনজি আমদানির কথা ভাবে সরকার।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ।
কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। এর আগেও ২০২২ সালের মার্চে কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অতিরিক্ত এলএনজি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু তখনো কাতার অস্বীকৃতি জানায়। পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের গ্যাস সংকটের বিষয়টি কাতারকে জানিয়ে এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে তাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দফায় দেশটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু সাড়া মিলেনি। প্রধান উপদেষ্টার সফর থেকে ইতিবাচক কিছু পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।
এখন যেহেতু আবার একটা সংকট তৈরি হয়েছে সেহেতু বাড়তি এলএনজি দিতে যদি দেশটির সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে ভালোই হবে।
জানা যায়, বর্তমানে দেশটি থেকে বছরে ৪০ কার্গো এলএনজি আসছে। যার ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম পরছে ১৫ মার্কিন ডলার। যুদ্ধের আগে এই দাম ছিল ১০ ডলারের কম।
তবে সংকট মোকাবিলায় আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কূপগুলোতে খননের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন কাতারের এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও চীন নিয়ে যাচ্ছে। কাতার আমাদের কাছের দেশ হওয়ায় এলএনজি আমদানিতে খরচ কম। বর্তমানে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে সাত মিলিয়ন টন। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আনা হয় প্রায় চার মিলিয়ন টন। বাকিটা স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে কেনা হয়।
আমাদের বছরে আরও দুই মিলিয়ন টন এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাড়াতে হবে। কাতার যদি এখন অতিরিক্ত এলএনজি দিতে না চায়, তাহলে আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এলএনজি চুক্তির বিষয়ে কথা বলতে পারি। বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এসবের বাইরে আমদানির দিকে না তাকিয়ে পেট্রোবাংলাকে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।