অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া আবাসন প্রকল্প ‘বীর নিবাস’ বরাদ্দের তালিকায় গলদ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই তালিকা থেকে ১৯১ জনকে সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে তাদের সচ্ছলতার ধরন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্ষেপে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বাধীন এডিপির সভায় সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৯১ জন মুক্তিযোদ্ধার সচ্ছলতা সম্পর্কে প্রমাণ মিললে বীর নিবাস বরাদ্দের তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হবে।
এছাড়া, যেসব বীর নিবাস বরাদ্দের জন্য ইতিমধ্যে টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো প্রকৃত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত হয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সংখ্যা ১ হাজার ৩১৭। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ-সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বীর নিবাস বরাদ্দের জন্য তালিকাভুক্ত ২৪৩ উপজেলার ১১ হাজার ২৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় যাচাইয়ে হাত দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে শনাক্ততে ১৯১ জনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
অতীত ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আবাস সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ নির্মাণে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ ধরে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। কিন্তু সময়মতো কাজ না এগোনোর কারণে দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ ধরা হয় বিগত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এজন্য প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৮২২ কোটি ২০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বীর নিবাস নির্মিত হয় মাত্র ১৩ হাজার ১২৯টি। নির্মাণাধীন ছিল আরও ৯ হাজার ১০২টি। গত ৫ আগস্টের পর প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ডিসেম্বরে মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এতে করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হন। ফলে তৃতীয় দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এ কারণেই বীর নিবাসের পুরো তালিকাই তলিয়ে দেখতে শুরু করেছে তারা। এর মধ্য দিয়ে আবারও প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হলো। তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে এবার আর ব্যয় বাড়ছে না। ৩০ হাজারের মধ্যে এবার বীর নিবাস নির্মিত হবে বাদবাকি ৭ হাজার ৭৬টি।
সংক্ষেপে বীর নিবাস: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে বীর নিবাস বরাদ্দ এবং তৈরি হয়েছে।
আগে (২০২১ সাল) প্রতিটি বীর নিবাস তৈরির জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে এই বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। নিজস্ব জমিতে বেশির ভাগ বীর নিবাস গড়ে উঠেছে। তবে ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাসজমি বরাদ্দ দিয়েও বীর নিবাস তৈরি করা হয়েছে। ৪ ডেসিমাল জমিতে গড়ে তোলা প্রতিটি বীর নিবাসের আয়তন ৭৩২ বর্গফুট। এই আয়তনের মধ্যে প্রতিটি একতলা বীর নিবাসে রয়েছে ২ বেডরুম, ১ ড্রয়িং, ১ ডাইনিং, ২ বাথরুম এবং ১ বারান্দা। এ ছাড়াও প্রতি বাড়িতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে একটি প্রশস্ত উঠান, ১ নলকূপ এবং হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালনের সুবিধার্থে একটি টিনশেড স্থপনা।
এদিকে বীর নিবাসের কার্যক্রম তৃতীয় দফায় শুরু করতে গিয়ে দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি। দেখা যাচ্ছে, বীর নিবাস নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের কর্মী কিংবা সমর্থক। অনেকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলাও রয়েছে। এসব ঠিকাদারের কেউ অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজ ফেলে পালিয়ে গেছেন, কেউ আবার অর্ধেক বিল উত্তোলন করেই লাপাত্তা। সব মিলিয়ে অর্ধসমাপ্ত বীর নিবাসের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১০২।
এমন বৈরী পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছে মন্ত্রণালয় এবং উপজেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে ঠিকাদারদের একাংশ উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন, মেয়াদ বাড়ানোর পর অর্থবরাদ্দ শুরু হলে তারা কাজে হাত দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্মাণকাজ শেষ হওয়া ২ হাজার ৫০৬টি বীর নিবাসের বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যগুলো পর্যায়ক্রমে পরিশোধের কথা মন্ত্রণালয়ের চিন্তায় রয়েছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই মূহূর্তে বিস্তারিত তথ্য আমার স্মরণে নেই। পরবর্তীতে ফাইল দেখে বলতে পারব।