ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

সেন্ট্রাল ফার্মার শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৫, ১২:০০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১২ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসার আগে থেকে কোম্পানির আর্থিক হিসাবে নয়ছয় করা হয়েছে। তবে ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ৯৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। একই সঙ্গে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করেন কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা।

প্রায় শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চিঠি ইতোমধ্যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব ফাঁকি চিঠির বিপরীতে আপিল করা হয়েছে বলে গতকাল শনিবার জানিয়েছে সেন্ট্রাল ফার্মা কর্তৃপক্ষ।

একইসঙ্গে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে ব্যর্থ ও কোম্পানির আর্থিক হিসাবে আরও শতকোটি টাকার বেশি নয়ছয় করার অভিযোগ দায়ের করেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোং। কোম্পানিটির নিরীক্ষকের মতে, সব মিলিয়ে কোম্পানির আর্থিক হিসাবে প্রায় ১৩৬ কোটি টাকার হিসাব গরমিল রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে গতকাল দেখা গেছে, সিকিউরিটিজ আইন পরিপন্থি হলেও সেন্ট্রাল ফার্মা উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে শেয়ার ধারণ করছেন মাত্র ৭.৬৭ শতাংশ। আইন অনুসারে, ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক।

অন্যদিকে, কোম্পানিটির ৯ লাখ টাকার অবণ্টিত লভ্যাংশ রয়েছে, যা বিএসইসির ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে স্থানান্তর করা হয়নি। একই সঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) ফি জমা দেয়নি। ডিএসইতে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মূল্য ছিল ১০.৪০ টাকা।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পরিবর্তনের পরেও নভেম্বর মাসে শেয়ার স্থিতি ছিল ২৫.৮৯ শতাংশ। সেই আইন ভঙ্গ করে গত ডিসেম্বর মাসে ২৫.৮৯ শতাংশ থেকে আরও ৭.৬৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেন তারা। বর্তমানে ৭.৬৭ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন উদ্যোক্তা পরিচালকরা। মোট শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার ১০.৫১ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে ৮১.৮২ শতাংশ শেয়ার।

১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানিটি বিভিন্ন অনিয়মে ডুবতে বসেছে। তবে ২৫.৮৯ শতাংশ শেয়ার থেকে নতুন করে শেয়ার বিক্রি সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৯৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ দায়ের করেছে এনবিআর। তবে এনবিআরের আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়; যার কারণে আমরা অভিযোগের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আশা করছি, ফল ভালো আসবে।

সিকিউরিজি আইন ভঙ্গ করে শেয়ার বিক্রি সম্পর্কে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আইডিএলসি থেকে প্রায় ২১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা শেয়ার বন্ডিংয়ের মাধ্যমে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় আইডিএলসি আদালতের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের মোট শেয়ার থেকে ৭.৬৭ শতাংশ গ্রহণ করে এবং সেকেন্ডারি মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিক্রি করে।

জনতা ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে ‘মোট ২৬ কোটি টাকা ঋণ স্থিতি রয়েছে এবং পরিশোধের কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ’ বলেন তাজুল ইসলাম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের কাছে ৯৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা আয়কর দাবি করে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানিটি এর বিপরীতে মাত্র ২৮ কোটি ৪ লাখ টাকার প্রভিশনিং করেছে। বাকি ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার বিপরীতে কোনো প্রভিশনিং করেনি। এর মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণ উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২২ সালের জুনের আগে থেকেই কোম্পানিটি ঋণের এই পরিমাণ প্রতিবেদন করছে, কিন্তু গত কয়েক বছরে ঋণের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ছাড়া, কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি এবং সুদের বিপরীতে কোনো নিরাপত্তা সঞ্চিতিও রাখা হয়নি। এ কারণে কোম্পানিটির ঋণ সম্পর্কিত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।

কোম্পানিটির নিরীক্ষকের মতে, সব মিলিয়ে কোম্পানিটির প্রায় ১৩৬ কোটি টাকার হিসাব গরমিল রয়েছে। কোম্পানিটির দাখিল করা আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লিখিত আয়, ব্যয়, গ্রাহকের কাছে পাওনা, স্থায়ী সম্পদ, অবণ্টিত লভ্যাংশ, ট্যাক্স প্রদান, ব্যাংক হিসাবের তথ্য, ডেফার্ড ট্যাক্সসহ আরও অনেক বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

কোম্পানিটি তার গ্রাহকদের কাছে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা পাওনা উল্লেখ করেছে। তবে এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি সরবরাহ করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে এই ঋণ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু নিরীক্ষকের আদায়ের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এদিকে, স্পেয়ার পার্টস অ্যান্ড সাপ্লাইস হিসেবে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার কোনো প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি, যা দীর্ঘদিন ধরে সম্পদ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো প্রভিশনিং করেনি। ফলে তারা সম্পদ বেশি দেখাচ্ছে।

নিরীক্ষক অভিযোগ করেছেন, কোম্পানিটি অধিকাংশ লেনদেন নগদে করে, যার ফলে লেনদেনের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। নগদ লেনদেনের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ রয়েছে। কোম্পানির অগ্রিম প্রদানের হিসাবেও ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে ২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা অগ্রিম আয়কর প্রদান হিসেবে উল্লেখ আছে। তবে এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণাদি প্রদান করতে পারেনি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস। সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস সবশেষ ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এরপর থেকে ২০২০, ২০২১, ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
কোম্পানির দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর ’২৪) শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৬ পয়সা। গত বছর একই সময়ে এই লোকসান ছিল ১৫ পয়সা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৮৯ পয়সায়। যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৭ টাকা ৬ পয়সা।