শেখ হাসিনার গেল ১৬ বছরের শাসনামলে নির্মিত সব আয়নাঘরের হদিস পাওয়া গেছে। সেখান থেকে একে একে বেরিয়ে এসেছেন গুম হওয়া অনেকেই। তবে যারা বেরিয়ে আসেননি, তাদের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে সরকার বা কোনো মহল থেকে কেউ কিছু বলেননি।
যদিও তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা পরিবারের সদস্যরা এরই মধ্যে অনুমান করে নিয়েছেন। গুমঘর থেকে ফিরে আসা কেউ কেউ না ফেরার তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের ব্যাপারে অনেক তথ্য দিয়েছেন। তারা নিশ্চিত করে কিছু না বললেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় তারা প্রায় নিশ্চিত; কী ঘটেছে তাদের ভাগ্যে। এরপর ধীর ধীরে অনেকে প্রিয়জন ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
সিলেটের অবিসংবাদিত নেতা এম ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিয়েও দীর্ঘদিন ধোঁয়াশার ঘোরে আবদ্ধ ছিল দেশবাসী। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়া হাসিনা আমলের সাবেক ডিজিএফআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গুমঘরের প্রধান হোতা মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান জানিয়ে দেন, কী পরিণতি হয়েছে সাহসী রাজনীতিক ইলিয়াস আলীর।
তার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, জিয়াউলের নেতৃত্বে এম ইলিয়াস আলীকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে। এ কথা জিয়াউল আহসান জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, যা তিনি আদালতকেও জানিয়েছেন।
এ তথ্য জানার পর সবাই আশাহত হয়ে পড়েন। খবর নিশ্চিত হওয়ার পর পরিবার ও সিলেটে দলের নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়েন। তবে কেউ কেউ সেই খবর মানতে নারাজ। সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন, ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন। তিনি ফিরে আসবেন। বিএনপি নেতারা এ নিয়ে নীরব ছিলেন। তারা সরকারের গুম কমিশনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিশ্চিত খবরের জন্য।
কিন্তু কমিশন এম. ইলিয়াস আলীর বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। ফলে দলের ভেতরেও আবার বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে, ‘ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন। তিনি ফিরে আসবেন!’ এমনকি ইলিয়াসপ্রিয় সাধারণ মানুষের মতো বিএনপির নেতারাও এখন মনে করেন, ইলিয়াস আলী এখনো ‘আয়নাঘরে’ বন্দি আছেন।
গত বৃহস্পতিবার এম. ইলিয়াস আলীর গুমবার্ষিকীতে সিলেট বিএনপির নেতারা ‘ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়া’র দাবিতে কর্মসূচি পালন করে সরকারের কাছে তাকে ফেরত চেয়েছেন। তারা অনুষ্ঠানমালায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমঘরে আছেন। তাকে ফিরিয়ে দিন।’ এমনকি ইলিয়াসপত্নী তাহমিনা রুশদী লুনাও স্বামীর ফিরে আসার ব্যাপারে আশাবাদী। দাবি জানিয়েছেন জনতার নেতাকে জনতার মাঝে ফিরিয়ে দেওয়ার।
যদিও রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছে, ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা প্রায় স্পষ্ট। তবে এখনো তাকে ‘ফিরে পাওয়ার’ দাবি মূলত রাজনৈতিক। ইলিয়াস ইস্যু জনগণের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে এবং ভোটের মাঠে ‘ইলিয়াস আবেগ’ কাজে লাগাতেই ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। এম ইলিয়াস আলী বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত নাম। বিএনপির ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। ছিলেন তিনি সিলেট-২ আসনের (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ) দাপুটে সংসদ সদস্য। ’৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকেই মূলত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে তার উত্থান।
এ সময় তিনি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেলে যাওয়ার পর থেকে ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসেন। ইলিয়াস আলী জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও সিলেটে ছিলেন অবিসংবাদিত। দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছে ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার যখন তুঙ্গে, তখনই ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গাড়িচালকসহ রাজধানী ঢাকার বনানী থেকে ‘গুম’ হন তিনি। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। কোনো চূড়ান্ত সত্য বেরিয়ে না আসায় এম ইলিয়াস আলীর পরিবারের অপেক্ষার অবসান হয়নি এখনো, ইলিয়াসরহস্য এখনো অমীমাংসিত।
১৭ এপ্রিল তার গুমবার্ষিকীতে সিলেটে নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। মানববন্ধন, সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদান ছিল কর্মসূচির মধ্যে। এসব কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা তাদের প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানান। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের নানা আশ্বাস সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি এখনো জীবিত এবং সংশ্লিষ্ট মহল তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত।’
তিনি গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত কমিশন গঠনের জোর দাবি জানান।
মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘সিলেটবাসীর হৃদয়ের নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ না পাওয়া আমাদের জন্য গভীর বেদনা ও ক্ষোভের বিষয়। এটি একটি জাতির জন্য চরম লজ্জার। আমরা ন্যায়বিচারের আশায় আজও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। একইভাবে নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেদ আহমদের ক্ষেত্রেও তাদের সন্ধান ও মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।’
ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমাদের নেতা এম ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন। আশা করছি, সরকার তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে সিলেটবাসীর প্রতি সুবিচার করবে।’
ইলিয়াস পরিবারের ঘনিষ্ঠজন এবং সিলেট জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সদস্য তানিমুল ইসলাম বলেন, গুম নামক অপরাজনীতির শিকার এম ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাকে শুধু বিশ্বনাথ বা সিলেটের প্রয়োজন নয়, পুরো দেশের জন্য এম ইলিয়াস আলীকে ফিরে আসতে হবে। তিনি বলেন, অতীতে যেসব ভুলের কারণে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছিল, বর্তমান সরকার যেন সেই ভুলগুলো না করে।