ঢাকা সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫

মাথাচাড়া দিচ্ছে আ.লীগ

রুবেল রহমান ও এফ এম শাহেদ
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের অবসানের পর রাজনীতিতে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকলেও বসে নেই রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন নিয়ে বহুমুখী বিতর্কের মধ্যেই নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সক্রিয় দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তবে আগামী নির্বাচনের সময়, সংস্কার ও মাঠের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরই সুযোগ নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রায়ই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল বের করছে আওয়ামী লীগ। ক্রমেই তাদের সাহস ও মিছিলের লোকের সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা আগের চেয়ে অনেক সক্রিয়। তাই পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতে বিএনপিসহ অন্য বড় দলগুলো তথা ছাত্র-জনতার ঐক্য জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।  

তাদের মতে, রমজানে ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে ভোটারদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিসহ অন্য দলগুলোর। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ সংসদীয় আসন চষে বেড়াচ্ছেন এখনো। নানা ছুতোয় ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন প্রার্থীপ্রত্যাশীরা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াত বেশির ভাগ আসনে এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। 

অন্যদিকে এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিজ দলের মধ্যে যেহেতু বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে না, মনোনয়নের ব্যাপারে তারা অনেকটা নিশ্চিত-নির্ভার। এনসিপির এসব নেতা নিজ নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পক্ষে তাদের সমর্থকরাও জোরেশোরে নেমেছেন প্রচারে। যদিও বিএনপি বলছে তাদের প্রার্থী নিয়ে চিন্তা নেই। তারা এখন ব্যস্ত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করার কাজে। বিএনপির ভাবনায় এখন জাতীয় নির্বাচন। দলটির আত্মবিশ্বাস প্রার্থী নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তাদের।  

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনার প্রচেষ্টা শুরু করেছে বিএনপি। এতে যুগপৎ কর্মসূচির শরিকেরা ছাড়াও বিগত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, এমন রাজনৈতিক দল, জোট ও সংগঠনগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা থাকবে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে। দফায় দফায় লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক করছে বিএনপি। এই উদ্যোগের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। তারই অংশ হিসেবে গত শনিবার বিকেলে ১২ দলীয় জোট ও সন্ধ্যায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। আর গতকাল রোববার সিপিবিসহ বাম দলগুলোর সঙ্গে বনানীতে হোটেল সারিনায় বৈঠক করেছে বিএনপি। 

তবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতানৈক্যে আওয়ামী লীগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিছু বিষয়ে ঐক্য হলেও দলগুলোর মধ্যে দাবিদাওয়া নিয়ে বাড়ছে দূরত্ব। এই যেমন আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষের আসন, ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল এনসিসি ও গণভোটে রাজি নয় বিএনপি। সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও গণভোট এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে শক্ত আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এ বিষয়ে কোনো আপসও করবে না বলে পরিষ্কার করেছে তারা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এবং রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে চলমান আলোচনায় গতকাল রোববারের নির্ধারিত আলোচনায়ও বিএনপি এই অবস্থান তুলে ধরেন। ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল এনসিসির প্রস্তাবনার সাথে একমত নয় বিএনপি। তবে বেশকিছু বিষয়ে একমত পোষণ করেছে দলটি। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচনকালীন রুটিন কাজ করার জন্য নব্বই দিন মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই চায় দলটি। আর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক না রেখে তা উন্মুক্ত রাখতে চায় বিএনপি। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনেরও প্রয়োজন দেখছে না দলটি। এসব বিষয় নিয়ে দিনে দিনে বাড়ছে জটিলতা। রুদ্ধ হওয়ার পথে ঐক্যের পথ। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দলটি কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। তারই জেরে মুলতবি সভা করে বিএনপি।
   
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতানৈক্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ। সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল বের করার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশত ঝটিকা মিছিল হয়েছে বলে জানা গেছে। সারা দেশে জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করছে। এসব মিছিলে ফটোসেশন করা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মী সোশ্যাল মিডিয়ায় ছদ্মনামের আইডিতে সেগুলো পোস্ট করছেন। মিছিলের ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের বাইরে পলাতক থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে। দিনে দিনে লম্বা হচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগের মিছিল। গর্ত থেকে বের হতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছে সরকারের ব্যর্থতাও এর জন্য কম দায়ী নয়। ঝটিকা মিছিল নিয়ে গত শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আওয়ামী লীগের মিছিল কন্ট্রোল করতে না পারলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে মিছিল না হতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা কন্ট্রোল না করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গত এক সপ্তাহে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সহস্রাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের আলাদা আদর্শ, আলাদা দর্শন। জামায়াত তাদের মতো করে দাবি তুলবে। এনসিপি তাদের মতো করে দাবি তুলবে। তাই বলে আমাদের মধ্যে অনৈক্য রয়েছে বিষয়টা এমন নয়। জাতীয় স্বার্থে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে। আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল করছে। তাদের দলের প্রধান পালিয়ে গেছে, কর্মীরা তো আর পালাতে পারেনি। তাই তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।  

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বড় দলগুলো একসাথে যেভাবে গত ১৬ বছর নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনাকে উৎখাত করেছে, সেভাবেই গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারসহ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে একমত রয়েছে। ফ্যাসিবাদ চেতনায় সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে,  মোটা দাগে আমাদের ভেতর কোনোরকম অনৈক্য নেই। আমরা যারা জুলাই আন্দোলনের মিত্র তারা অটুট রয়েছি। রিফাইন আওয়ামী লীগ এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগকে কোনোরকম সুযোগ দেওয়া যাবে না, এ বিষয়েও আমরা সবাই একমত এটা জামায়াতে ইসলামীর কথা। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শুরু থেকে বলে আসছি বিচার এবং সংস্কার আমাদের প্রাধান্যের বিষয়। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের জন্য রাজনৈতিক যে লড়াইটা প্রয়োজন তা আমরা করে যাচ্ছি এবং শুরু থেকেই আমরা তা বলে যাচ্ছি। তবে, দুঃখজনক হচ্ছে, নির্বাচনই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে, আওয়ামী লীগ মনে করছে তাদের ভেতর একটি বিভেদ আছে এবং সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। মোটাদাগে এই বিভক্তিগুলো রাজনৈতিক, সংস্কার এবং প্রস্তাবনার বিষয়ে দ্বি-মত থাকতেই পারে এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। তবে, এগুলোর সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ মিছিল করার সুযোগ পায় সেটি দুঃখজনক। এটি এনসিপি শুধু নয়, বিএনপির জন্যও আশঙ্কার। আ.লীগ যখন ছিল তখন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি ভবিষ্যতেও সে আশক্সক্ষা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে সব দলের ওপর প্রভাব পড়বে।