মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৫, ১১:৩০ পিএম

ক্যানসার হাসপাতাল নিজেই রোগী

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৫, ১১:৩০ পিএম

ক্যানসার হাসপাতাল নিজেই রোগী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার একমাত্র আশ্রয়স্থল জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসেন হাজারো রোগী। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করেন দিনের পর দিন। কিন্তু মরণপথযাত্রী এসব রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিজেই জরাগ্রস্ত। 

হাসপাতালে থাকা ৬টি পুরাতন রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে সবগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন করে দুইটি মেশিন কেনা হলেও একটি নষ্ট। অন্যটি চালু থাকলেও একবার থেরাপি নিতে গেলে রোগীদের অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। এমআরআই মেশিনটি এত দিন কাজ করলেও সম্প্রতি সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে। 

১ বছরের বেশি সময় ধরে একমাত্র এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট থাকার পর কয়েক দিন আগে চালু হলেও এর সিরিয়াল পাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। ৩০০ শয্যার জনবল নিয়ে চিকিৎসা চলছে ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে। এমন পরিস্থিতি খোদ চিকিৎসকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাসপাতালটির সব উন্নয়ন কার্যক্রম একপ্রকার স্থবির ছিল উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের দাবি, হয় সক্ষমতা বাড়ানো হোক, না হলে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হোক। রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দিতে না পারার অসহায়ত্ব তাদের চোখে-মুখে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল ছয়টি। যেগুলোর সবগুলোরই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই সম্প্রতি আরও দুইটি মেশিন কেনা হয়েছে। কিন্তু এগুলোরও একটি নষ্ট। এমআরই মেশিন একটি থাকলেও সেটি অচল। হাসপাতালজুড়ে রয়েছে মাত্র একটি এক্স-রে মেশিন। 

সেটিও নষ্ট ছিল ১ বছরের বেশি সময় ধরে। এতসব না থাকার মধ্যেও ভোর থেকেই হাসপাতালটির রেডিওথেরাপিরুমের সামনে দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। সিরিয়াল না পেলেও কোনোভাবে যদি সুযোগ পাওয়া যায়, সেই অপেক্ষায় সকাল ৭টা থেকে লাইন দাঁড়িয়ে রয়েছে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত শিল্পী সাহার মেয়ে সীমা সাহা। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে গত বছরের শেষে। চিকিৎসক এরপর নিয়মিত ৮টি রেডিওথেরাপি দেওয়ার কথা বলেছেন। এত দিন একটি বেসরকারি হাসপাতালে থেরাপি দিলেও সম্প্রতি হাত একেবারে খালি। আর তাই সরকারি হাসপাতালটিতে এসেছে একটি রেডিওথেরাপির সিরিয়াল। এর আগে আরও তিন দিন এসেছিলেন; কিন্তু সিরিয়াল না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই থেরাপির পুরো কোর্সে খরচ হয় দেড় লাখ টাকার মতো। এমনিতেই মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্বপ্রায়। এমন অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়া অসম্ভব। সরকারিভাবে মাত্র খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল। গত তিন দিন ঘুরে গিয়েছি। 

আজ আবার লাইনে দাঁড়িয়েছি। সিরিয়াল পাই কি না দেখি। সিরিয়াল পেতে এমন দেরি কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের দায়িত্বরত এক কর্মী জানান, মেশিন মাত্র একটি। এটা দিয়ে কয়জনকে থেরাপি দেওয়া যায় বলেন? আমরা তো বসে নাই। রোগীদের সেবা দিচ্ছি। কিন্তু একটি মেশিনের বিপরীতে এত রোগী যে একেকজনের সিরিয়াল পেতে ১০ থেকে ১৫ দিন লেগে যায়।
একই অবস্থা হাসপাতালটির এক্স-রে রুমের সামনেও। 

হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীই ডাক্তারের পরামর্শে এক্স-রে করতে ভিড় করছেন এক্স-রে রুমের সামনে। রংপুর থেকে মুখগহ্বরে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী প্রিন্স বলেন, দুই দিন পর পরই ডাক্তার মুখের পরিস্থিতি দেখার জন্য এক্স রে করাতে দেন। যেদিনই এক্স-রে দেন সেদিনই এখানে আসি এক্স-রে করাতে। কিন্তু সিরিয়াল পেতে গেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ওই দিন আর কোনো কাজ করার সুযোগ থাকে না। এখানে এক্স-রের জন্য সিরিয়ালে দাঁড়াব না চিকিৎসা নেব কিছুই বুঝতে পারি না। 

ক্যানসার রোগীদের বিভিন্ন সময় এমআরআই পরীক্ষা করার প্রয়োজন পরে। কিন্তু হাসপাতালে মাত্র একটি এমআরআই মেশিনও নষ্ট জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের নিজেদের কাছেই খারাপ লাগে, যখন রোগীকে বলতে হয় বাইরে থেকে এমআরআই পরীক্ষাটি করিয়ে আসেন। ক্যানসার এমন একটি রোগ, যেখানে রোগীর চিকিৎসায় পরিবারকে সর্বস্ব খোয়াতে হয়। এমন অবস্থায় একটি পরীক্ষাও তাদের জন্য বোঝা। কিন্তু মেশিন না থাকায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের পরীক্ষার জন্যও একটা এমআরআই মেশিন নেই এখানে। যা খুবই দুঃখজনক।

শুধু কী মেশিন! হাসপাতালটির সর্বত্র নোংরা-আবর্জনা এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যে অনেকে এটাকে ভাগাড়ের সঙ্গেও তুলনা করেন। হাসপাতালের সাত তলার একটি ওয়ার্ডের চিকিৎসা নেওয়া প্রোস্টেট ক্যানসারের রোগীর স্ত্রী অভিযোগ করেন, ক্যানসারের কারণে স্বামীর অপারেশন হয়েছিল দুই মাস আগে। হাসপাতালের পরিবেশ এত নোংরা যে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়Ñ এই বুঝি ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে। এই বুঝি ইনফেকশন হয়ে গেল। হাসপাতালের বিছানায় তেলাপোকা গিজ গিজ করত। শেষরক্ষা হয়নি। হাসপাতালে থেকেই অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন হয়। এবং তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় গত মাসে আমার স্বামী মারা যান। ক্যানসারের অপারেশনের রোগীকে যেখানে উচ্চ স্যানিটাইজড কক্ষে রাখার দরকার, সেখানে এমন নোংরা পরিবেশে তো ইনফেকশন হবেই। আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা তো হয়েছেই। এখন সরকারের কাছে আবেদন জানাই হাসপাতাল তৈরি করেছেন। একটু পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করেন। না হলে সব আয়োজন বৃথা।

কেন হাসপাতালটি যথাযথভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা যায় নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতালটির এক কর্তাব্যক্তি বলেন, এর অন্যতম কারণ জনবল। চিকিৎসক বলেন, নার্স বলেন, আর আয়াই বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় এখানে সবই কম। একটা ৫০০ শয্যার হাসপাতালে যে পরিমাণ জনবল থাকার কথা, এখানে তার অর্ধেক জনবলও অনেক বিভাগে নেই। আউটসোর্সিংয়ে কিছু তৃতীয় শ্রেণির কর্মী নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তা-ও বন্ধ। 

তাহলে পরিষ্কারটা করবে কে? জনবল সংকটের প্রমাণ পাওয়া গেল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারেও। হাসপাতালটিতে আটটি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও এখানে এনেস্থেসিস্ট রয়েছে মাত্র ৩ থেকে ৪ জন। ফলে চাইলেই একসঙ্গে বেশি রোগীকে অপারেশন করতে পারছেন না সার্জারির চিকিৎসকরা। 

একজন চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর ব্যথার তীব্রতা একজন সুস্থ মানুষ কিছুতেই অনুভব করতে পারবে না। শরীরের ক্যানসার আক্রান্ত অংশ যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু শুধু এনেস্থেসিস্টের অভাবে অপারেশন থিয়েটার প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও বেশি রোগীর অপারেশন করা সম্ভব হয় না। এতে করে রোগীদের লম্বা অপারেশনের জন্য লম্বা সিরিয়াল তৈরি হয়। তখন এখানে কাজ করে নিজে নিজেই যেন আত্মগ্লানিতে ভুগি। 

জনবল সংকটের কথা স্বীকার করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশে প্রতিবছর এক লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে মারা যাচ্ছে। এ হিসাবে রোগটিতে দৈনিক গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ জন মারা যাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশে এখন প্রায় ২০ লাখ ক্যানসার রোগী আছে। 

কিন্তু এদের চিকিৎসায় দেশে মাত্র একটি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। এখানেও প্রয়োজনের তুলনায় জনবলসংকট রয়েছে। তবে ক্যানসার চিকিৎসাক্ষেত্রে ঢাকার ওপর অতিরিক্ত চাপ কমাতে স্বাস্থ্যসেবাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে। জনবল বাড়ানো যায় কি না তা নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।  

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!