চলতি বছর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ‘টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী হয়েছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য দেশের ৬৪ জেলা থেকে ‘নমুনা সংগ্রহের’ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জেলার শিক্ষার্থীসংখ্যার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত চাহিদার সামঞ্জস্য রয়েছে কি না তা যাচাই করে পরিদর্শন প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মনিটরিং কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
মনিটরিং কমিটির এই পরিদর্শনের মাধ্যমে কোন প্রেসগুলো নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে তা যেমন জানা যাবে, তেমনি শিক্ষার্থীর বিপরীতে বইয়ের চাহিদার সঠিক পরিমাণ সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা হবে। বিগত বছরগুলোতে সীমিত আকারে জেলা থেকে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এবারই প্রথম ব্যাপকভাবে কাজটি করছে এনসিটিবি। চলতি মাস থেকেই শুরু হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এনসিটিবি।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের পর বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজটি করে এনসিটিবির নিয়োগ করা পোস্ট-ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) এজেন্ট। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে নিম্নমানের বই নিয়ে এনসিটিবির বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। সে কারণে এবার মাধ্যমিক স্তরে পিএলআইয়ের পাশাপাশি নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে পিএলআই এজেন্টের কাজের স্বচ্ছতা বজায় থাকার পাশাপাশি বইয়ের মান সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থীর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বইয়ের চাহিদার সঠিক তথ্যও নিরূপণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে এনসিটিবি।
এদিকে গত ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবারের এক আদেশে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরুর কথা থাকলেও গত রোববার তা স্থগিত করা হয়। সিদ্ধান্ত স্থগিতের কারণ নিয়ে এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, স্থগিতের সিদ্ধান্ত সাময়িক। চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে মান যাচাইয়ের কাজ।
অন্যদিকে একটি সিন্ডিকেটের ব্যাপক তদবির সত্ত্বেও অবশেষে নিয়ম অনুযায়ী পিএলআইয়ের কাজের ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দেওয়া হয়েছে এনসিটিবির টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসেসকে। নিয়মের পক্ষে এনসিটিবির অবস্থান শক্ত থাকায় তদবির শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবে এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তির কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি পিএলআই এজেন্ট। বিষয়টি দ্রুত শেষ না হলে এনসিটিবির কাছে বকেয়া টাকা পেতে দেরি হবে প্রেসগুলোর, পাশাপাশি ২০২৬ সালের বই তৈরির বাজেটও দেরি হবে। এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নিম্নমান শনাক্তে কমিটি : নিম্নমানের বই শনাক্তে দেশের ৬৪ জেলার জন্য ৩২টি কমিটি করা হয়েছে। এনসিটিবির দুইজন কর্মকর্তা একটি করে জেলা ঘুরে নিম্নমানের বই সংগ্রহ করবেন। পাশাপাশি ওই জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়া বইয়ের চাহিদার পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবেন। প্রথম পর্যায়ে ১৬টি কমিটি ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৬টি কমিটি এই কাজটি করবে।
এ ক্ষেত্রে কোন জেলাগুলো আগে পরিদর্শন করা হবে তা ‘র্যান্ডমলি’ নির্বাচন করা হতে পারে। এ ছাড়া যে জেলাগুলোতে সরবরাহ করা বই নিয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে সেগুলোও আগে পরিদর্শন করা হতে পারে। পরবর্তী সময়ে সংগ্রহ করা বইয়ের নমুনা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ন্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনসহ সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে বইয়ের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ।
এনসিটিবির একটি সূত্র ৩২টি কমিটি গঠনের কথা জানালেও আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে যেহেতু ২০২৬ সালের বই পরিমার্জন-সংশোধনসহ ছাপার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ চলছে তাই কমিটির সংখ্যা কমতেও পারে। সে ক্ষেত্রে যে জেলাগুলোর বই নিয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে শুধু সেগুলোই পরিদর্শন করবে মনিটারিং কমিটি।
গত ১৭ এপ্রিল এনসিটিবি এক অফিস আদেশে মনিটরিং কমিটির কর্মকর্তাদের মান যাচাইয়ের জন্য নির্দেশনা দেয়। আদেশে বলা হয়, বইয়ের মান বোর্ডের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়েছে কি না এবং শিক্ষার্থী সংখ্যার সাথে প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা যাচাই করে পরিদর্শন প্রতিবেদন বোর্ড সদস্যের (পাঠ্যপুস্তক) কাছে জমা দিতে হবে।
এদিকে গত রোববার থেকে এই পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এদিন সকালে এক নির্দেশে তা স্থগিতের কথা জানানো হয় মনিটরিং কর্মকর্তাদের। কাজ শুরু না হতেই স্থগিতের সিদ্ধান্তে বিষয়টি নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়। তবে জানা গেছে, মনিটরিং কর্মকর্তাদের অনেকেই ২০২৬ সালের বইয়ের কনটেন্ট তৈরির কাজে ব্যস্ত। অসুস্থতার জন্য কয়েকজন আবার এই মুহূর্তে পরিদর্শনে যেতে চাচ্ছেন না। তাই সাময়িকভাবে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।
চলতি বছর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪০ কোটি বই বিতরণ করেছে এনসিটিবি। ভালো মানের বই দিতে এনসিটিবির কড়া তৎপরতার পাশাপাশি প্রিন্টার্সদেরও সদিচ্ছা ছিল। তাই বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো মানের বই পেয়েছে। তবে বিভিন্ন জেলায় নিম্নমানের বই দেওয়ায় খবরও এনসিটিবি পাচ্ছে বলে জানা গেছে। জেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা নিম্নমানের বই কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মনিটরিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিম্নমানের বই ও বইয়ের চাহিদার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রবিউল কবীর চৌধুরী। সিদ্ধান্ত স্থগিতের বিষয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আগামী বছরের বইয়ের পরিমার্জনের কাজ চলছে। তাই আপাতত স্থগিত হলেও চলতি মাসেই পরিদর্শনের কাজ শুরু হবে।
তিনি আরো বলেন, কর্মকর্তারা নিম্নমানের বইয়ের নমুনা সংগ্রহ করবে। পাশাপাশি বইয়ের চাহিদার পরিমাণ ক্রসচেক করবেন। তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিজেদের জন্যই নিম্নমানের বই ও বইয়ের চাহিদার তথ্য জানা প্রয়োজন মন্তব্য করে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, এই কাজটি এবার ব্যাপক আকারেই করতে চাচ্ছি। এটি সফলভাবে করতে পারলে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের কাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আরো বলেন, পিপিআর অনুযায়ী পিএলআইয়ের পাশাপাশি এনসিটিবি এটি করতে পারে। আগে না হলেও এবার সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে।
স্বচ্ছতা আসবে পিএলআইয়ের কাজে : বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে টেন্ডারের মাধ্যমে এনসিটিবি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দুইটি ইন্সপেকশন কোম্পানিকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি ইন্সপেকশন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পায়। প্রাথমিক স্তরে পিডিআই ও পিএলআই ইন্সপেকশনের কাজ একই কোম্পানি করলেও মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশনের কাজ দুটি আলাদা কোম্পানিকে দেওয়া হয়।
শর্ত অনুযায়ী, বইয়ের উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই)। অন্যদিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহের পর বইয়ের মান যাচাইয়ের তদারকি করে পিএলআই এজেন্ট।
বইয়ের মান সম্পর্কে পিএলআই এজেন্টের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ছাপা কাজের ২০ শতাংশ বকেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা নেয় এনসিটিবি। শর্ত অনুযায়ী যারা বই সরবরাহ করতে পারেনি তাদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এত ব্যবস্থার পরও বিগত বছরগুলোতে নিম্নমানের বই সরবরাহ বন্ধ করা যায়নি। খারাপ বই দেওয়ার বিষয়ে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ও ইন্সপেকশন এজেন্টদের দায়ী করত এনসিটিবি। আবার মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ও ইন্সপেকশন এজেন্টরা নিম্নমানের বইয়ের জন্য এনসিটিবির নানা নির্দেশনার ওপর দায় চাপাত।
গত ৫ আগস্ট সাবেক আওয়ামী সরকারের পতনের পর চলতি বছরের বই মুদ্রণ ও সরবরাহের কাজ শুরু করে এনসিটিবি। শিক্ষার্থীরা যাতে এবার শতভাগ গুণগত মানসম্পন্ন বই পায় সে জন্য সরকারের নির্দেশে প্রথম থেকেই তৎপর ছিল এনসিটিবি। এ জন্য বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরের বই ছাপার কাজে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়। ভালো দর পাওয়ায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও মানসম্মত বই দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। দ্বিতীয়ত, বইয়ের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ শতভাগ সঠিক করার লক্ষ্যে টেন্ডারে ৬ নম্বরে থাকা ‘ব্যুরো ভেরিটাস’ নামে একটি কোম্পানিকে সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে ২৫ লাখ টাকা বেশিতে পিডিআই ইন্সপেকশন এজেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও নিম্নমানের বই সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
মাধ্যমিক স্তরে এবার পিডিআই ও পিএলআইয়ের টেন্ডার প্রথমে একসঙ্গে করা হয়। কিন্তু পিএলআইয়ের দর কম হওয়ায় দ্বিতীয়বার টেন্ডার করা হয়। টেন্ডারে ১৭ লাখ টাকা দর দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসেস। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা একটি কোম্পানিকে কাজটি দেওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করে একটি সিন্ডিকেট। তবে এনসিটিবির কঠিন অবস্থানের কারণে এটি সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে কাজ পাওয়া কোম্পানিকে এনসিটিবির পক্ষ থেকে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্যবার শুধু পিএলআই এজেন্টের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করা হলেও এবার এনসিটিবির মনিটরিং কর্মকর্তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনের সঙ্গে যাচাই করার সুযোগ থাকছে। তাই পিএলআইয়ের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি পিডিআই এজেন্টের ইন্সপেকশনের পরও কীভাবে নিম্নমানের বই সরবরাহ করা হলো সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
এ বিষয়ে এনসটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়া ইন্সপেকশন এজেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর শিগগিরই চুক্তির কাজ শেষ করবে এনসিটিবি। এবার এনসিটিবির মনিটরিং কমিটিও পরিদর্শনের কাজ করায় পিএলআইয়ের কাজও স্বচ্ছতার মধ্যে আসবে বলে মনে করেন তিনি।