যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই, সেই বয়সে নারায়ণগঞ্জে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ায় মাদকাসক্ত কিশোররা। দিন থেকে রাত সব সময়, সবখানেই তাদের অবাধ বিচরণ। দিন দিন বাড়ছে তাদের অপরাধের মাত্রা। ফলে শিশু-কিশোরসহ যুবসমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও কিশোরগ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের সর্বাধিক পরিকল্পিত পূর্বাচল উপশহর, জামদানি ও তাঁতশিল্পসহ ভৌগোলিক কারণে রূপগঞ্জ উপজেলার গুরুত্ব অনেক। ২৪৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এ উপজেলার সর্বমোট আয়তন ১৭৬.০৮ বর্গকিলোমিটার। এতে ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে ২ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বৃহৎ এই শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বাসস্থানে ভ্রাম্যমাণ লোকের সংখ্যা অনেক বেশি।
এখানকার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭,০৪,০৭২ জন। রূপগঞ্জের বাইরে থেকে আসা তরুণদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মাদক, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ফলে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা প্রদানসহ নানা অন্যায়-অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ বিশিষ্টজনদের।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৬ এপ্রিল রাত আড়াইটার দিকে উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করার সময় একটি রিভলবার ও ম্যাগাজিনসহ বায়জিদ (১৪) নামে এক কিশোরকে আটক করে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। আটককৃত বায়জিদ কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের মানিকপুর এলাকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে এবং বর্তমানে কর্ণগোপ এলাকার একটি বাড়ির ভাড়াটিয়া। পরে আটককৃত বায়জিদকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে পাঠায় পুলিশ।
গত ১৯ মার্চ রাতে মাদক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের আনোয়ার হোসেনের ছেলে হাসিবকে (২৭) বিদেশি পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়।
এর আগে ৮ মার্চ বিকেলে উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নের মাহমুদাবাদ স্কুলের সামনে অস্ত্র কেনা-বেচার সময় আমির হামজা (২০) ও হামিম (২৪) নামে ২ সন্ত্রাসীকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন ও ৮ রাউন্ড গুলিসহ আটক করে অস্ত্র আইনে নারায়ণগঞ্জ আদালতে পাঠায় পুলিশ। পতিত সরকারের দোসররা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কিশোর থেকে যুবক সব বয়সে ছেলেদের বিভিন্ন প্রলোভনে অপরাধ জগতে ঢুকিয়ে রাখত। আর তাদের দিয়ে অস্ত্র ব্যবসা, মাদক কারবারী, ভূমি দস্যুতা, খুনসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটাত। আর এসব ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে ও অপরাধ দমনে সামাজিক আন্দোলনের পরামর্শ বিশিষ্টজনদের।
এদিকে, মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাং নির্মূলে সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার বিকেলে উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনা এলাকায় ‘যুবশক্তি ব্লাড ফাউন্ডেশন’, ‘মাহনা পূর্বপাড়া সমাজবাসী’, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় প্রতিনিধি’ ও ‘মাহনা আদর্শ সেবা সংগঠন’সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও গ্রামবাসীর উদ্যোগে উঠান বৈঠক, আলোচনা সভা ও প্রতিবাদ মিছিল করা হয়েছে।
সভায় মাহনা পূর্বপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি রুস্তম আলী ভূইয়ার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, যুবশক্তি ব্লাড ফাউন্ডেশনের সভাপতি জাকির মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক নাঈম ভূঁইয়া নয়ন, প্রতিষ্ঠাতা মোহসীন মোল্লা, উপদেষ্টা আওলাদ হোসেন, মাহনা আদর্শ সেবা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা জাকির হোসেন, প্রচার সম্পাদক ইফাজ আহাম্মেদ, সহ-কোষাধ্যক্ষ রুহুল আমীন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় প্রতিনিধি জুনায়েদ আহাম্মেদ আকাশ, মাহনা পূর্বপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাংগঠনিক সম্পাদক মোশাররফ মোল্লা, গোলাকান্দাইল ৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি মনির হোসেন মোল্লা, ৩নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি ইয়াকুব, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল, মাহনা পূর্বপাড়া সামাজিক প্রতিবাদ সংগঠনের সদস্য জসিম, হৃদয়, ইব্রাহীম, মামুন, নিহার, শাকিল, মাহনা পূর্বপাড়া সমাজবাসী সংগঠনের সদস্যবৃন্দসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
এ সময় বক্তারা বলেন, মাদক যুবসমাজসহ গোটা সমাজকেই ধ্বংস করে দেয়। একজন মাদকাসক্তের দ্বারা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। তাই যুবসমাজকে ভালো রাখতে হলে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হয়। তাই এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সের মানুষেরা এসব অপরাধের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর করে প্রতিবাদ জানান এবং সমাজকে কলুষমুক্ত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
এসব বিষয়ে সলিমউদ্দিন চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর মালুম বলেন, সমাজ থেকে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাংসহ নানা গুরুতর অপরাধ দমন করতে পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। পাশাপাশি শিশু-কিশোর ও যুবকদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।
কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের মহাসচিব মীর আব্দুল আলীম বলেন, মাদক আজ গোটা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন মাদকাসক্ত তার পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা। তাই কিশোর অপরাধ ধমন করে যুবসমাজকে বাঁচাতে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
এসব বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (গ-সার্কেল) মেহেদী ইসলাম বলেন, মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিং, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অস্ত্র ও মাদকসহ সন্ত্রসীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সবার সহযোগিতাই পারে সমাজকে এসব অপরাধ থেকে মুক্ত করতে।
আপনার মতামত লিখুন :