রাজধানীর গুলশান-বনানী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তের পর থেকে চালকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে বনানী ১১ নম্বর রোড এলাকায় লাঠি দিয়ে বেশ কয়েকজনকে মারধর করার অভিযোগ উঠে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বিরুদ্ধে। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর দাবিতে তাদের এই আন্দোলন বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে।
গতকাল সোমবার আন্দোলন চলাকালে যারা ছবি-ভিডিও ধারণ করেন তাদের ওপর হামলা চালান চালকরা। এমনকি তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি প্রাইভেট চালক, সাধারণ মানুষ ও বাইকাররা। বিশেষ করে অটোচালকেরা বাইক ও বাইকারদের দেখলেই তাদের ওপর এলোপাতাড়ি হামলা করতে থাকে। এই হামলার ঘটনায় ১০ জন আহত হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, ঢাকার গুলশান-বনানী কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত, সম্প্রতি এসব এলাকায় বেড়েছে বিভিন্ন অপরাধ। যার কারণে শক্ত হচ্ছে সোসাইটি ও পুলিশ।
গুলশান ও বনানী থানা পুলিশের বিশেষ এক সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পর গুলশান-বানানীতে যেসব নৈরাজ্য হয়েছে এসবের পেছনে বস্তিতে থাকা অটোচালকেরা রয়েছে। তা ছাড়া সম্প্রতি গুলশান-বনানীতে খুন-ছিনতাই-চাঁদাবাজি, মাদক ও যানজটের পেছনে অটোরিকশার একক আধিপত্য। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই এসব এলাকায় ঘটিত বেশকিছু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বনানী থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গুলশান সোসাইটির নিবন্ধিত রিকশাগুলো গুলশান এলাকার যাত্রী পরিবহন করে থাকে। সম্প্রতি গুলশান এলাকায় ছিনতাই-চাঁদাবাজি ও যানজট বেড়ে গেছে। কারণ, অনিবন্ধিত রিকশার চলাচল বেড়েছে। এ জন্য নিবন্ধিত রিকশা ছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সোসাইটির এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি রিকশাচালকরা। তারা গত কয়েকদিন ধরে গুলশানের বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চালানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনার সময় গুলশান-বনানীর বিভিন্ন সড়কে ও আশপাশের প্রধান সড়কে অবস্থান নেন অটোরিকশাচালকরা। কয়েকটি স্থানে প্যাডেলচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেল চালকদের মারধরের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। এসব ঘটনার কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বিদেশিদের হয়রানি করতেও দেখা গেছে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বেশ কয়েকজন মোটরসাইকেল চালককে লাঠি দিয়ে মারধর করে; ঠিক সেই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এ ছাড়াও অভিযোগ উঠে, বনানী ২১ নম্বর রোডে দুজন প্যাডেলচালিত রিকশাচালককে খালে ফেলে দেয় অটোচালকেরা। এসব ঘটনায় স্থানীয় জনতা ও ব্যবসায়ীদের মাঝেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। তারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে।
অটোচালকদের নৈরাজ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বনানী ১১ নম্বর রোডে অবস্থান করতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ কাজ করতে থাকে; তবে, পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এ সময় দেখা যায়, যারাই অটোচালকদের তাণ্ডবের আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও নেওয়ার চেষ্টা করছে চালকেরা তাদের ওপার হামলা ও ধাওয়া দিয়েছে এবং রিকশাচালকরা লাঠিপেটা করেছে। পরে সেনাবাহিনী ও আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।
ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সেনাবাহিনী
গুলশান-বনানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে। গতকাল এ আন্দোলনের কেউ আন্দোলনের ছবি কিংবা ভিডিও করলেই তাকে ধাওয়া দিয়ে লাঠিপেটা করছিল অটোরিকশাচালকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এদিন দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসে এবং ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
গুলশানে ব্যাটারি ও প্যাডেলচালিতদের মুখোমুখি সংঘর্ষ
গুলশান এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সহিংসতার ঘটনায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউর রহমান বলেন, পুলিশ, সিটি করপোরেশন ও গুলশান সোসাইটি যৌথভাবে এলাকাটি ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত রাখতে কাজ করছে। কিছু রিকশাচালক এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ হওয়ায় উত্তেজনা তৈরি করে।
‘গুলশান সোসাইটির পক্ষ থেকে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নিবন্ধিত প্যাডেলচালিত রিকশা ছাড়া অন্য কোনো রিকশা গুলশানে প্রবেশ করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের সহায়তায় চেকপোস্ট বসানো হয়। এ কারণেই উত্তেজনার সূত্রপাত বলে জানান পুলিশের এই কর্মকতা।
ট্রাফিক পুলিশের বক্স ও ব্যারিকেডে হামলা
‘এর আগে বনানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা জড়ো হয়ে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের মুখোমুখি হয়। এ ঘটনায় একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের কয়েকটি রিকশা ভাঙচুর এবং ব্রিজ এলাকার ট্রাফিক পুলিশের বক্স ও ব্যারিকেডে হামলা করে’।
বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) এ কে এম মইনুদ্দিন বলেন, এই ঘটনাটি আমরা দুপুরের দিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই।
এদিকে এ ঘটনাকে ‘তাণ্ডব’ আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক নাগরিক। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাফিক বক্সে হামলা, ব্যারিকেড টান দেওয়া এবং কিছু রিকশা ও মোটরসাইকেল ভাঙচুরের দৃশ্য। এর আগেও গত শনিবার গুলশানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর চালকেরা বিক্ষোভ করেন এবং কিছু প্যাডেলচালিত রিকশা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেদিনও দুপুরের দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
জানতে চাইলে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর সাদাত রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ব্যাটারি রিকশার মাধ্যমে স্থানীয় ও বিদেশি নাগরিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। সেই কারণে আদালতের নির্দেশনা ও গুলশান বনানীর নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এক দিনে সব সম্ভব নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এসব এলাকায় নিরাপদ নিশ্চিত করতেই আমরা কাজ করছি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কাম্য।
গুলশান-বনানী কূটনৈতিক জোনে বেড়েছে বিভিন্ন অপরাধ
সূত্র জানায়, ঢাকার গুলশান-বনানী কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত। গুলশান-বনানীর নিরাপত্তাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নেওয়া হয়েছিল নানা উদ্যোগ। সেই সময় নতুন রূপে কমসংখ্যক রিকশা নিবন্ধন করে চলাচলের অনুমতি দেন আদালত। এরপর সেই নিয়মে চলতে থাকে। পরে ৫ আগস্টের পর আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যায় এলাকাটি। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা।
সম্প্রতি গুলশান-বনানীতে খুন-ছিনতাই-চাঁদাবাজি, মাদক ও যানজটসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় এর পেছনে গোয়েন্দা পুলিশ ও সোসাইটি মনে করছে এসব অপরাধের পেছনে রিকশাচালকদের যোগসূত্র আছে। এ জন্য তারা অটোচালকদের আধিপত্য ভেঙে দিতে শক্ত হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, মূলত নিরাপত্তার জন্যই এই বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।