রূপালী বাংলাদেশ: আপনি একজন ব্যবসায়ী এবং সম্পাদক ও প্রকাশক। এই অবস্থান থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজন অনুভব করলেন কেন?
রফিকুল আমীন: আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাকে ১২ বছর বেকার করে রাখা হয়েছিল। গত ১২ বছর ধরে আমি ব্যবসায়ী বা কোনো ধরনের পরিচয়ে পরিচিত নই। সহজভাবে বললে গত একযুগ ধরে আমি নির্যাতিত হয়ে বন্দি ছিলাম। ২০১২ সালের জুলাই থেকে আমার ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়। গণমাধ্যম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই যে অপরাজনীতির শিকার আমি হলাম এটি কেন হলাম, সেটির উত্তর খুঁজেছি। সঠিক রাজনীতি ও রাজনীতিতে সংস্কারের অভাবের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব। একইসঙ্গে সংস্কারের যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমি মনে করি, বর্তমান সরকারকে সময় দিয়ে সংস্কারের জন্য পাশে থাকলে দেশের উন্নতি হবে। আমি আমার স্থান থেকে সেই চেষ্টাই করতে চাচ্ছি। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-২৪ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা, আইনের সুশাসন, সবার জন্য শিক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আয় বৈষম্য নিরসন ও সামাজিক সুরক্ষা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অনুন্নত সম্প্রদায় এবং অনগ্রসর গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে কাজ করবে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি।
রূপালী বাংলাদেশ: সংগঠন তৈরিতে কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি অথবা নির্দিষ্ট কোন বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন?
রফিকুল আমীন: না, তেমন বিশেষ কোনোকিছু নয়। আমি শুধু প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শের ভিত্তিতেই জুলুম, অত্যাচার বন্ধের জন্য, আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্যই রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূলত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলতে, রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের যে গুরুত্ব রয়েছে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই দল গড়ে তোলা হয়েছে। দল গঠনের ক্ষেত্রে আমি আমার কোম্পানির কোনো পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করিনি।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনার ওপর হওয়া অন্যায়-বঞ্চনার বিষয়ে কিছু বলুন
রফিকুল আমীন: গত এক যুগ ধরে আমার ওপর যে অত্যাচার জুলুম করা হয়েছে সেটি কেউ বলছে না। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরদিন থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা জেল থেকে অসংখ্য বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আমি নিজে দেখেছি। জেল সুপারের কাছে জানতে চেয়েছি, এত মানুষ ছাড়ছেন, আমাকে কেন ছাড়া হচ্ছে না? তিনি আমাকে জানান, আপনার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সেখানে হেফাজত ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হুজিসহ নানা দলের নেতাকর্মীরা ছিল। ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এত স্মার্ট ফোন কীভাবে জেলের ভেতর ঢুকেছে সেটি দেখেও আমি অবাক হয়েছি। অনেক বড় নেতাকে বিভিন্নভাবে বের করা হয়েছে। কোথায় ছিল তখন ন্যায়বিচার? আমাকে ছাড়া হয়নিÑ কারণ, আমার কোনো রাজনৈতিক ট্যাগ নেই। সুতরাং আমাকে অবশ্যই রাজনীতি করতে হবে, আমাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশেই আমার রাজনৈতিক দল গঠন করা। ক্ষমতা নয়, অন্যায় প্রতিবাদে দল গঠন করা হয়েছে। আমার স্ত্রী যিনি অসুস্থ, এখনো তাকে ছাড়া হচ্ছে না।
রূপালী বাংলাদেশ: কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে দলের পরিকল্পনা কীভাবে কাজ করবে?
রফিকুল আমীন: আমাদের দেশ দৃশ্যত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পনির্ভর বা শিল্পপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ দেশের জনসাধারণ কৃষির সাথে জীবন ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। ফলে, আমি কৃষিকে শিল্প হিসেবে অভিহিত করতে চাই, কৃষিকে শিল্প না বললে যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না। কৃষকরা অবহেলিত, আমি চাই তারা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য বাড়িতে বসে পাবে। ভোক্তা পণ্য পাবে সঠিক দামে। মধ্যস্বত্বভোগির যে সিন্ডিকেট তা ভেঙে দেব টেকনোলজি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। আমাদের কাছে টেকনোলজি রয়েছে সুতরাং কেন পারব না আমরা! আর এই টেকনোলজি ব্যবহার করতে হলে যে একটি পরিচয় প্রয়োজন তা হলো রাজনীতি।
রূপালী বাংলাদেশ: আগামীর রাজনীতি কেমন দেখতে চান?
রফিকুল আমীন: আমরা নানা সময়ে বারবার স্বৈরাচার বিদায় করেছি। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। কেন আমরা স্বৈরাচার হওয়া বন্ধ করছি না! আমি চাই, আগামীর রাজনীতি হবে জনগণের জন্য, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে কেউ নতুন করে স্বৈরচার হয়ে উঠতে পারবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: নির্বাচন নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
রফিকুল আমীন: ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকার রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো নয়। এই সরকারের সামনে রয়েছে জাতীয় আকাক্সক্ষা, যা রাজপথের আন্দোলন থেকে উত্থিত ও গৃহীত। শুধু নির্বাচনের জন্য এই সরকার গঠিত হয়নি এটি আমাদের বুঝতে হবে। দেশের প্রয়োজনে অবশ্যই সংস্কার করার সুযোগ দিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল এমন কোনো সংস্কার করবে না, যা তাদের মতের বাইরে যায়। সুতরাং সংস্কারের জন্য অবশ্যই আমাদের সময় ও সুযোগ দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ড. ইউনূস আমাদের জন্য আশীর্বাদ এটা বুঝতে হবে। এই সুযোগ দেশের ছাত্র-জনতা আমাদের তাদের প্রাণের বিনিময়ে দিয়েছে। তবে, নির্বাচন যদি ডিসেম্বরের আগেও হয় নতুন দল হিসেবে বা আমার ব্যক্তি জায়গা থেকে কোনো সমস্যা নেই। একইভাবে নির্বাচন দুই বছর পর হলেও কোনো আপত্তি নেই।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে কী বলবেন?
রফিকুল আমীন: আমার বিরুদ্ধে দুদক কখনো দুর্নীতি বা অর্থ আত্মসাতের কোনো মামলা করেনি। দুদকের যে এজাহার সেখানে উল্লেখ করা হয়, আমি মানিলন্ডারিং করেছি। অর্থাৎ ব্যবসার মাধ্যমে যে টাকা আমি গ্রহণ করেছি এবং সেই অর্থ যে যে খাতে খরচ বা ইনভেস্ট করেছি সেটা মানিলন্ডারিং। যেমন, আমি গ্রাহকের টাকা নিয়ে সিনেমা হল বা মিল-কারখানা কিনেছি এগুলো মানিলন্ডারিং! আমি জানতে চেয়েছি কেন এগুলো মানিলন্ডারিং হলো? তারা আমাকে বলেছেন, আমি কেন যাদের থেকে টাকা গ্রহণ করেছি তাদের না জানিয়ে এই ব্যবসা বা কারখানা কিনেছি বা ইনভেস্ট করেছি! সেখানে আমার উত্তর ছিল তাদের টাকা তো ব্যবসার উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করেছি, কেন তাদের মতামত নিতে হবে!
জেলখানায় আমি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করি, ‘ভাই আমাকে কেন জেলে ভরলেন’, তিনি কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। মাথা নিচু করে বলেছেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে করেছেন। এখন যারা আমার বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ-দুর্নাম করছে তাদের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ : ধন্যবাদ আপনাকে
রফিকুল আমীন : আপনাকেও ধন্যবাদ
আপনার মতামত লিখুন :