ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধ্বংসের মিশনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট

রূপালী প্রতিবেদক 
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ০৫:৩১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধ্বংস করার জন্য আবারও তৎপরতা শুরু করেছে শক্তিশালী একটি চক্র। আগামী ২১-২২ মে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণসহ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্পর্কিত তৃতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার আগে এই চক্রটি নানান অপতৎপরতা শুরু করেছে। 

এতে মালয়েশিয়ায় আগামী ৬ বছরে প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারেও তারা নানা অপতৎপরতা শুরু করেছে চক্রটি। এতে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনশক্তি রপ্তানি খাতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি খাতকে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) কিছু বহিষ্কৃত নেতা। তারা সৌদি আরবের পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়াকে ঘিরে দেশের ভেতরে বিভিন্ন প্রকার নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছে।

ওইসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ মালয়েশিয়া কর্মী গ্রহণকারী দেশ হওয়ায় সে দেশে সরকার সমালোচনার মধ্যে পড়লে বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করতে পারে। এতে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, যাদের অপতৎপরতায় শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের অন্যতম হচ্ছে বায়রার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন ধামাসী করপোরেশনের নোমান চৌধুরী। এই চক্রটি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করছে। তারা আরেক মাফিয়া নূর আলীর সঙ্গে মিলে রেমিট্যান্স শাটডাউনের নীলনকশা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মূলত নিজ এলাকার বিতর্কিত এমপি ফেনীর নিজাম হাজারীর প্রেসক্রিপশনে চলছেন। তার সঙ্গে আছেন একই জেলার আলাউদ্দিন নাসিম ও আবুল বাশার। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক না নেওয়ার জন্য এই চক্রটি দৌড়ঝাঁপ করছেন। 

তারা আরও বলেন, মালয়েশিয়া যখন বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে তখন নানা অবান্তর শর্ত,  মিথ্যাচার আর সংবাদ সম্মেলন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। বর্তমান ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। মালয়েশিয়া থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা বন্ধ করাই ফখরুলদের মূল উদ্দেশ্য।

জানা গেছে, জনশক্তি রপ্তানি খাতে জাল-জালিয়াতির অভিযোগে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন নথিপত্র তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটির কাছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মী প্রেরণের বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়ার মূল কপি ও সত্যায়িত কপি চেয়েছে দুদক। এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিক প্রেরণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও দূতাবাসের সত্যায়নকৃত ডিমান্ড নোটের অপব্যবহার করায় এক বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারকে।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেডিকেল সেন্টারে প্রায় ৭০ হাজার কর্মীর মেডিকেল চেকআপ করে হাতিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। কিছুদিন আগে রাজধানীর পল্টন থানায় তার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন অপর একজন ব্যবসায়ী।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়, হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ফ্যাসিবাদী সরকারের একজন দোসর। তিনিসহ আরও কয়েকজন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে আসছেন। তার ধারাবাহিকতায় ফখরুল ইসলাম গত ৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার তিন ব্যক্তিকে গোপনে  বাংলাদেশে আনেন। 

তাদের গোপনে মালয়েশিয়ান সরকারি প্রতিনিধি সাজিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিগণকে সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয় দেন। ওই ব্যক্তিরা ফখরুল ইসলামের সহযোগিতায় নিজেদের মালয়েশিয়ান সরকারের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নানান অপতৎপরতা চালান।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ফখরুলকে সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে একটি অভিযোগ জমা হয়েছে। ওই অভিযোগে বলা হয়, পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বাণিজ্যে ১০ সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিলেন ফখরুল ইসলাম। মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাণিজ্যের জন্য বাগিয়ে নিয়েছেন নিজের মেডিকেল সেন্টার ওয়েলকাম মেডিকেল। 

এখানে প্রায় ৭০ হাজার কর্মীর নামমাত্র স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। পরে তিনি পরিচয় লুকিয়ে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তার কমপক্ষে দুইটি লাইসেন্স রয়েছে ১০১ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়। সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়ও রয়েছে তার এজেন্সি ও ওয়েলকাম মেডিকেল সেন্টার।

১০১ সিন্ডিকেটভুক্ত ফখরুল ইসলামের বেনামি প্রতিষ্ঠান ছিল ত্রিবেণি ইন্টারন্যাশনাল ও সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানায় অন্য ব্যক্তির নাম থাকলেও যার নেপথ্য মালিক ও অংশীদার ফখরুল ইসলাম। তিনি নিজের লাইসেন্স সরাসরি ব্যবহার না করে অন্যের নামে ব্যবসা করছেন। অন্য যারা ব্যবসা করেন তাদের লাইসেন্স ছিল একটি। আর ফখরুল ব্যবসা করেছেন দুই লাইসেন্সে। তা ছাড়া অন্য ব্যবসায়ীরা মূল ১০১ এজেন্সির মধ্যে অথবা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ছিলেন। আবার অনেকে ছিলেন শুধু মেডিকেল সেন্টার ব্যবসায়। কিন্তু ফখরুলই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সব জায়গায় আছেন এবং দেদার ব্যবসা করেছেন।

গত বছরের ৩১ মে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর ফখরুল ইসলামসহ কয়েকজন মিলে ভিন্ন কৌশলে সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর কতিপয় নেতার সঙ্গে তাদের কয়েকজনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ভাইরাল হয়েছে। মালয়েশিয়ার একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মোটা অঙ্কের অর্থ স্পন্সর করার সূত্রে দাওয়াত পান ফখরুল ও তার সহযোগীরা। শুধু তাই নয়, দেখা করেছিলেন মালয়েশিয়া সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। সেখানকার কর্মকর্তারা তার প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ায় দেশে ফিরে নিজেকে বঞ্চিত দাবি করে শুরু করেছেন নানা অপতৎপরতা।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী জানান, ফখরুল এখন বায়রার সভাপতি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের অনুকম্পা পেতে সিন্ডিকেটবিরোধী কথা বলছেন। অথচ তিনি সব সময়ই সিন্ডিকেটের অংশ ছিলেন এবং নিজেও সিন্ডিকেট করেছেন। ফখরুলের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন টক শো, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে শ্রমবাজারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার বক্তব্যগুলো তার অনুসারীরা মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ায় সম্ভাব্য নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশি শ্রমিকবিমুখ হচ্ছেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক ও বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্ববিরোধী বক্তব্য দেন। তিনি সেখানে মালয়েশিয়ায় পুরোনো সিন্ডিকেট তৈরি কথা বলেন। তার দাবি, ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশে কার্যকর করতে পারেননি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি মিথ্যাচার। এফডব্লিউসিএমএস মালয়েশিয়ার জনশক্তি আমাদানিবিষয়ক সফটওয়্যার। সব সোর্স কান্ট্রি থেকে তারা শ্রমিক নিয়ে থাকেন। ফখরুলের দাবি, এফডব্লিউসিএমএস দুই দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে। যা নির্লজ্জ মিথ্যাচার।

দুদকের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জনশক্তি রপ্তানি খাতে নানা অনিয়মের মাধ্যমে মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর প্লটে করেছেন ১০ তলা ভবন। এই ভবনে তার হিউম্যান রিসোর্স ও ওয়েলকাম মেডিকেল সেন্টারের কার্যালয়। 

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় করেছেন বাড়ি। নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞার ওমরপুরে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ক্রয় করেছেন তিনি। এসব অভিযোগের বিষয়ে ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলি। এ জন্য আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বায়রার নেতা পরিচয় দিয়ে ফখরুল ইসলাম ও তার সহযোগী নোমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা তথ্য সংবলিত স্মারকলিপিসহ অভিযোগ করে যাচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য শ্রমবাজার তথা দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।