বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:৩০ পিএম

পঙ্গুর পঙ্গুত্ব দূর হবে কবে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:৩০ পিএম

পঙ্গুর পঙ্গুত্ব দূর হবে কবে

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সংক্ষেপে বলা হয় নিটোর। সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত পঙ্গু হাসপাতাল নামে। রাজধানীসহ সারা দেশের দুর্ঘটনার শিকার, হাড় ভাঙাসহ সার্জারিসংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল। 

কিন্তু এই আশ্রয়স্থলেরই যেন পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি নেই বছরে পর বছরেও। চরম বেড সংকটসহ নানা সংকটে জর্জরিত হাসপাতালটিতে রোগীদের চিকিৎসা পেতে অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়। রোগীদের অভিযোগ, ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহ পরও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখতে আসা দূরে থাক, নেন না ন্যূনতম খবরও। মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও পাওয়া যায় না অপারেশনের তারিখ। শুধু তাই নয়, দালালদের দৌরাত্ম্যে নাভিশ্বাস অবস্থা রোগী ও স্বজনদের। বিশেষায়িত একমাত্র হাসপাতালটির এমন বেহাল অবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষকে দুষছেন রোগীর স্বজনরা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহতদের অনেকেও সেখানকার চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সরকার পরিবর্তনের কোনো প্রভাবই পরে না হাসপাতালটিতে। 

চলতি মাসের ৭ তারিখ সড়ক দুর্ঘটনায় কোমড়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয় হবিগঞ্জের রিচি ইউনিয়নের সেলিম রহমানকে (ছদ্মনাম)। ১৭ এপ্রিল পেরিয়ে গেলেও যে চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি হয়েছেন সেই চিকিৎসকের টিকিটি দেখতে পাননি তিনি। 

ক্ষোভ জানিয়ে রোগীর বড় ভাই বরকত (ছদ্মনাম) বলেন, গত ৭ তারিখে এখানে ভর্তি করিয়েছি ছোট ভাইকে। ১০ দিন হয়ে গেলেও ডিউটি ডাক্তারের বাইরে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নামগন্ধ দেখিনি কোথাও। তারা ব্যথার ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন অপারেশন করতে হবে। কিন্তু কবে অপারেশন করবে, কে করবে কিছুই বলেননি। ভাইয়ের পুরো পরিবার হাসপাতালে রয়েছেন। এ ছাড়া এখানে বেড বা সিট পেতেও চলে নার্স ও ওয়ার্ডবয়সহ স্টাফদের বাণিজ্য। 

টানা ৫ দিন হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেও নিজের বাথরুমে পরে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলা ছোট্ট শিশু সুলতানাকে ভর্তি করাতে পারেননি রেজওয়ান হোসেন। প্রতিদিন আউটডোরে এসে ফিরে যাচ্ছেন। কীভাবে ভর্তি হবেন বুঝতে না পেরে দুই একজনের কাছে জিজ্ঞেস করতেই পাশ থেকে একজন অপরিচিত লোক এসে বলেন, এই হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসা পেতে পেতে ১ সপ্তাহ লেগে যাবে। তারচেয়ে পাশের বেসরকারি হাসপাতালে গেলে দ্রুততম সময়ে মেয়েকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরতে পারবেন। 

প্রায় ৪ মাস যাবত হাসপাতালটিতে পায়ের গোড়ালির হাড় ভাঙা স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালটির সাত তলার নতুন ওয়ার্ডে রয়েছেন শিপ্রা তালুকদার (ছদ্মনাম)। প্রথম দুই মাস পরিচালক, বিভাগীয় প্রধানসহ এই ডাক্তার ওই ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করেও অপারেশনের তারিখ পায়নি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তিন বেলা নিজেদের জন্য বরাদ্দ রাখা সরকারি খাবার খেয়ে হাসপাতালের বারান্দাতেই শিশুকন্যাটিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। থাকার জন্য ন্যূনতম যা যা দরকার মশারি, বালিশ, চাদর এমনকি কিছু হাড়ি-পাতিলও কিনেছেন বেলা-অবেলায় পছন্দের কিছু খাবার বানানোর জন্য। হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘কি আর করুম কন। সেই কুড়িগ্রাম থেকে আসছি রোগীরে নিয়ে। তাও প্রায় ৪ মাস হইয়া গেছে। এখনো ডাক্তার বলেনি কবে অপারেশন করবে। বাড়ি গিয়া আবার ফিরা আসা তো মুখের কথা না। তাই এইখানেই অপেক্ষা করতাছি কবে অপারেশনের তারিখ দেয়।’

শুধু সুমতি সরকার নয়, মাসের পর মাস অপারেশনের তারিখ না পেয়ে এমন অস্থায়ীভাবে বাড়িঘর বানিয়েছেন আরও অনেকেই। সবারই অভিযোগ, দুই থেকে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পাওয়া যাচ্ছে না কাক্সিক্ষত অপারেশনের তারিখ। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত দুই দিন অপারেশন হয়। রোগীর পরিমাণ এত বেশি যে, দিনে যে পরিমাণ অপারেশন হয় তা দিয়ে একমাসে ২০-২৫ জনের বেশি অপারেশন করা সম্ভব হয় না। আর বেশির ভাগ অপারেশনই অনেক জটিল। তাই সময়ও ব্যয় হয় বেশি। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে অপেক্ষমাণ রোগী থাকে শতাধিক। তাই একজন রোগীর অপারেশনের তারিখ পেতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এ ছাড়া এখানে গরিব রোগীরা সিট পান খুবই কম। চলে সিট বা বেড বাণিজ্য। 

তবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। তিনি বলেন, আপনারা জানেন আমরা একটি পরিবর্তিত সময় পার করছি। সব খাতেই সংস্কার চলছে। হাসপাতালেও যারা অনিয়ম করছেন তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পঙ্গু হাসপাতালের এ অভিযোগ নতুন নয়। প্রায় সময়ই আমরা এটির বিষয়ে অভিযোগ পাই। হাসপাতালের কাজ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়রানি করা নয়। 

অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা নিয়েও। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ নিয়মমাফিক ১০ টাকার টিকিট কাটলেও এর বাইরেও দায়িত্বরতদের দিতে হয় বাড়তি টাকা। প্রায় দুই মাস আগে বাবার সঙ্গে রাগ করে নিজে নিজেই দেয়ালে হাত দিয়ে বাড়ি মেরে আঘাত পান মালিবাগের সিয়াম আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সিয়াম বলেন, প্রথমে একবার এসে প্লাস্টার করে গিয়েছিলাম। তখন বাইরে থেকে নিজেরা প্লাস্টারের সামগ্রী নিয়ে আসলে নার্সরা তাদের খুশি করার কথা বললে আমার বাবা ১ হাজার টাকা দেন। এবারও ৮০০ টাকা দিতে হয়েছে। একই অভিযোগ করেন মাস দুই আগে খেলতে গিয়ে পা ভাঙা শিশু ইয়াসিরের বাবা আকবর হোসেনও। 

তিনি বলেন, ভেঙে যাওয়া পায়ের প্লাস্টার খুলে ড্রেসিং করিয়ে দ্বিতীয় দফা প্লাস্টার করে দিয়েছেন বহির্বিভাগে কর্মরত নার্সরা। কিন্তু প্রথমবার যখন এসেছিলেন তখন বিনা মূল্যের প্লাস্টার করাতে বয়দের দিতে হয়েছে ২ হাজার টাকা। এবার বহির্বিভাগে এসেছেন। পুরোনো প্লাস্টার খুলে নতুন করে করা হয়েছে। এবারো ১০ টাকার বাইরে তাদের চা-পান খেতে দিতে হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। চরম বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেন, এমন অবস্থা শুধু আমারই নয়। আমি তো রাজধানীর রোগী। গ্রাম থেকে যারা এসেছে তাদের অবস্থা চিন্তাও করতে পারবেন না। সেদিন দেখলাম নোয়াখালীর এক রোগীর কাছ থেকে প্লাস্টার করার জন্য নিয়েছে ২২শ টাকা। প্রথমবার নাকি তাদের কাছ থেকে নিয়েছিল ১৮শ টাকা। উৎকোচ ছাড়া এখানে সেবা মেলা কল্পনাতীত।

তবে হাসপাতালের দেয়ালে পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কেনানের স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করবে যে কারোই। ওই নোটিশে লেখা রয়েছে- ‘হাসপাতালে যেকোনো বিভাগে রোগীদের নিকট হতে ড্রেসিং, প্লাস্টার ও ট্রলিতে রোগীবহনসহ বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ কিন্তু ওই নোটিশ দেয়ালেই বন্দি বলে অভিযোগ এখানে আসা সাধারণ রোগীদের। 

সরেজিমনে দেখা যায়, হাসপাতালটির নতুন ভবনের বহির্বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্লাস্টার ড্রেসিং রুম। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এখানে সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাড়া সেবা মেলে না রোগীদের। তাদের ভাষায় এটাকে বলা হয় বকশিশ। তবে জোরজরবদস্তি আদায় করা হয় এই বকশিশ। এ বিভাগে কর্মরত রয়েছেন ৯ জন পুরুষ সিনিয়র স্টাফ নার্স। নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে এখানে দিনে সেবা নেন অন্তত: ৫০০ রোগী। রোগীর স্বজনরা জানান, নার্সরা যার কাছ থেকে যেভাবে পারছেন বকশিশের নামে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। গড়ে প্রতিদিন হাসপাতালটির এই বিভাগে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বলেন, কেউ তো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে করে না। করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!