ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ মাদকের নিরাপদ রুট

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:৪৯ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

লাগেজ স্ক্যানার, যাত্রী তল্লাশির সুযোগ না থাকায় এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি কম থাকায় এই পথকেই মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাদক কারবারীরা। মাদক পরিবহনের জন্য সৈকত ও প্রবাল এক্সপ্রেসকেই অধিকতর নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে মনে করছেন তারা।

কক্সবাজার থেকে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ ব্যক্তিগত যানবাহনে মাদক পাচার হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সড়কপথে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে মাদক পরিবহন। বারবার অভিযান পরিচালনা করেও আশানুরূপ মাদক উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছেন র‌্যাব, পুলিশ ও মাদক দ্রব্য অধিদপ্তর। এমন শঙ্কার কথা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

পর্যটকবাহী কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে মাদকের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বাড়ায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, কক্সবাজার যেহেতু পর্যটননির্ভর সমুদ্রবেষ্টিত এলাকা সেহেতু পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। হোক সেটা রেলওয়ে স্টেশন কিংবা বিমানবন্দর।

র‌্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নান্দনিকতার আবহে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনকে তৈরি করা হলেও নিরাপত্তাসহ মাদক পাচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় অপূর্ণ রেখেই ২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লাগেজ স্ক্যানারসহ যাত্রী তল্লাশিব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেনপথ উদ্বোধন মাদক পাচার কারবারিদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এ ছাড়া মাদকপাচার নিয়ন্ত্রণ করতে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মধ্যবর্তী স্টেশন ষোলশহর, জানালীহাট, গুমদণ্ডি, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান তদারকি বাড়ানো দাবি জানিয়েছেন তারা।

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেলপথ চালু হওয়ার পর সড়কপথে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে মাদক পরিবহন। বারবার অভিযান চালানোর পরেও আশানুরূপ মাদক উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। রেলপথ চালু হওয়ার আগে সোর্স ছাড়াও নিজস্ব তথ্য কালেকশনে সড়কপথের মাদক পাচারের যে পরিমাণ তথ্য পাওয়া যেতম রেলপথ চালু হওয়ার পর তা এখন শূন্যের কোটায়। সোর্স ব্যবহার করেও মহাসড়কে মাদকপাচারের তথ্য পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি স্বীকার করে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (এডি) কাজী দিদারুল আলম বলেন, ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনপথ চালু হওয়ার পর সড়কপথে মাদক পাচার কমে গেছে। যে কারণে আমাদের উদ্ধারের হারও কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আইনি জটিলতার কারণে আমরা চাইলেও ট্রেন থামিয়ে কিংবা চলতি পথে ট্রেনের বগিতে তল্লাশি চালাতে পারি না। যে কারণে আমদের বিশেষ কিছু করার থাকে না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), জেলা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, র‌্যাব ৭, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো এবং মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম দক্ষিণÑ সরকারের এই ৬ প্রতিষ্ঠানে ৪ মাসে (নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি) ৯৩১টি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজার ২৬৭ জন। উদ্ধার হয়েছে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ৭৬৯পিস ইয়াবা, গাঁজা ৭ হাজার ৫৬৭ কেজি, ফেনসিডিল ৯৯ বোতল, চোলাই মদ ৮ হাজার ৭৪১ লিটার, বেদেশি মদ ৭৬ বোতল, ২৬ লিটার, হুইস্কি ৫ বোতল, বিয়ার ৯০ বোতল, ক্রিস্টাল আইস ৪৭৫ গ্রাম এবং ৯৪ গ্রাম হিরোইন।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশে চার মাসে মাদকের মামলা হয়েছে ৩২৬টি আর গ্রেপ্তার ৪৩৬ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪১০ পিস, গাঁজা ১৪৯ কেজি, ফেনসিডিল ৪২৪ বোতল, বিদেশি মদ ৮ ক্যান ও ২০ লিটার, বিয়ার ২০ ক্যান। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশে মাদকের মামলা হয়েছে ২৬টি আর গ্রেপ্তার ২৩ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১২ হাজার ৩৮০ পিস, গাঁজা ৪৪ কেজি।

মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চল ৯৯ মামলায় গ্রেপ্তার ১০৭ জন আর উদ্ধারের তালিকায় রয়েছে ইয়াবা ৩২ হাজার ৯৭৫ পিস, গাঁজা ৩ হাজার ৫৮৬ কেজি, বিদেশি মদ ৮ বোতল। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম দক্ষিণে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তিন মাসে মাদকের মামলা হয়েছে ১১২টি আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২৪ জনকে। ৩ মাসে উদ্ধারের তালিকায় রয়েছে ইয়াবা ৪৬ হাজার, ৬৮৮ পিস, গাঁজা ৩ হাজার ৫০৬ কেজি, বিদেশি মদ ১২ বোতল আর চোলাই মদ ৮০ লিটার। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি চার মাসে ৮০টি মামলায় মাদকসহ ৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব; উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা ৭৪ হাজার ৬১০ পিস, ফেন্সিডিল ২ হাজার ৩৮৬ বোতল, বিদেশি মদ ১৬১ বোতল এবং আইস ৪৭৫ গ্রাম। 

মাদক মামলার আসামিসহ উদ্ধারকৃত মাদক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যার। মাদক উদ্ধারের এই হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সড়কপথের চেয়ে রেলপথ অধিকতর নিরাপদ হওয়ায় রেলপথে বাড়ছে মাদকপাচার। যে কারণে মহাসড়কে কমেছে মাদক উদ্ধার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেলপথ উদ্বোধনের পর কক্সবাজার স্টেশনে দুটো লাগেজ স্ক্যানার বসানোর জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার। দেড় বছর সময় পেরিয়ে গেলেও টনক নড়েনি রেল কর্তৃপক্ষের। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা সভায় স্ক্যানার বসানোর বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে তুলে ধরেন পুলিশ সুপার।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সুবক্ত গীন বলেন, লাগেজ স্ক্যানার রেলওয়ে পুলিশ বসানোর কথা। যদি বসিয়ে না থাকে তাহলে আমরা বসানোর ব্যবস্থা করব। তবে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থপক সুবক্ত গীনের এই বক্তব্যকে দায়সারা বলছেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, স্ক্যানারের বিষয়টি অনেক আগেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। 

এক প্রশ্নে জবাবে পুলিশ সুপার আরও বলেন, ট্রেন আসার পর স্টেশনে যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ার সুযোগটি নিচ্ছে মাদক পাচারকারীরা। স্টেশনে যদি দুটো স্ক্যানার বসানো যায় তা হলে ট্রেনে মাদকপাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

রেলওয়ে পুলিশের সাবেক এক পুলিশ সুপার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানান, রেল দিয়ে মাদকসহ অন্যান্য জিনিস পাচার অধিকতর সহজ। কারণ ট্রেন আসার পর যাত্রীদের একটা চাপ থাকে যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্বেও সবাইকে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, রেলওয়ে পুলিশে কর্তব্যরত পুলিশের সংখ্যা নগণ্য। এই অল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়ে সমুদ্রবেষ্টিত পর্যটক সমৃদ্ধ একটা জোনের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা কঠিন। কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনকে বিমানবন্দরের আদলে নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। যোগ করেন তিনি।

কক্সবাজার স্টেশনে মাদকের বিষয়ে তদারকি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার সাইফউদ্দীন শাহিন বলেন, মাদকপাচারের ক্ষেত্রে রেলস্টেশন অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। প্রয়োজনে গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করা হবে।