মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর সীমান্তে মনু নদীর বাংলাদেশ অংশে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের বাধায় গত ৫ সাস ধরে ব্লক স্থাপন করা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের অবহিতকরণে কলকাতায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকেও এখন পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হয়নি। এ অবস্থায় আগামী বর্ষায় উজানের ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে এলে মনু নদীর পানিতে সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) বাধায় কৈলাশহর শ্মশানঘাট এলাকার ভারতীয় অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ গত ৪ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার সূত্রে জানা যায়, গত বছর বন্যায় কুলাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। এসব এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গত বছর থেকেই পাথরের ব্লক তৈরি করা শুরু হয়। পাথরের ব্লক তৈরি শেষ হলেও গত জানুয়ারি ২০২৫ থেকে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশের মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের বাধায় এ কাজ বন্ধ রয়েছে।
আরও জানা যায়, বাংলাদেশ অংশে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ অস্বাভাবিকভাবে উঁচু করা হচ্ছে আর উঁচু হলে ভারতের ত্রিপুরার ঊনখোটি জেলার কৈলাশহর বন্যাকবলিত হবে- এ অপপ্রচারে গত জানুয়ারিতে কৈলাশহর তথা আগরতলায় ভারতীয় জনতা পার্টি, কংগ্রেস ও সিপিএম বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও প্রতিবাদ সভা করে। তারা ত্রিপুরা থেকে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে বিএসএফের মাধ্যমে জোরালোভাবে বাধা দিয়ে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ বন্ধ রেখেছে।
বাংলাদেশ অংশে সংস্কারকাজ না করতে প্রতিবাদে ও ভারতীয় অংশে মনু নদের বাঁধ নির্মাণের দাবিতে কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা লংমার্চ ও প্রতিবাদ সভা করে। গত ২৫ জানুয়ারি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করে ভারতীয় কংগ্রেসের ঊনকোটি জেলা কমিটি। তার আগে ভারতীয় জনতা পার্টি কৈলাশহর ও আগরতলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।
ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কৈলাশহরের অংশে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ খুব শীঘ্রই সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণের দাবিতে এবং দেবীপুর এলাকায় ভারত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ যে বাঁধ সংস্কার করছে তারই প্রতিবাদে ঊনকোটি জেলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কৈলাশহর-কুমারঘাট রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। তার আগ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি, সিপিএম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
গত ২৫ জানুয়ারি কৈলাশহর কংগ্রেসের পক্ষে কৈলাশহরের বিমানবন্দরসংলগ্ন কৈলাশহর-কুমারঘাট রাস্তা অবরোধ করে শত শত দলীয় কর্মী-সমর্থকরা এই রাস্তা অবরোধে শামিল হয়েছিল। রাস্তা অবরোধের নেতৃত্বে ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের কংগ্রেসের বিধায়ক বিরজিত সিনহা, ঊনকোটি জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মো. বদরুজ্জামান, প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রুদ্রেন্দু ভট্টাচার্য, যুব কংগ্রেসের ঊনকোটি জেলা কমিটির সভাপতি দেবাংশু দাস কংগ্রেস নেতা চন্দ্রশেখর সিনহা, নরসিংহ দাস, যুবনেতা দ্বীপ সিনহাসহ অন্যান্য নেতা।
অবরোধস্থলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কংগ্রেস বিধায়ক বিরজিত সিনহা বলেছিলেন, কৈলাশহর মহকুমায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। খুব শীঘ্রই এই বাঁধ সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণ করা না হলে আসন্ন বর্ষাকালে গোটা কৈলাশহর জলের নিচে তলিয়ে যাবে। তা ছাড়া দেবীপুর এলাকায় ভারত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করছে, তারও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ অংশে যে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার হচ্ছে তা অবৈধ। এ জন্য তারা প্রতিবাদ করছেন।
তবে অন্যদিকে সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ অংশে মনু নদে উঁচু প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ অভিযোগে গত ১৮ জানুয়ারি বিকেলে সরেজমিন তদন্ত করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফে পানি সাগরের ডিআইজি রাজিব বাটসরাজ টিলা বাজার বিএসএফ ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ অংশে মনু নদে উঁচু বাঁধ নির্মাণ সঠিক নয় বলে জানান।
সম্প্রতি সরেজমিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাথরের ব্লক তৈরি করে জমাট করে রাখা আছে। বাংলাদেশ অংশে কোন প্রতিরক্ষা বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপন হচ্ছে না। গত বছরের বন্যা যে এলাকার বাঁধ ভেঙেছিল, সে এলাকায় পাথরের ব্লক স্থাপন কাজও বন্ধ রয়েছে। তা ছাড়া শরীফপুর-কুলাউড়া সংযোগ সড়কের কাজও বিএসএফের আপত্তির কারণে বন্ধ রয়েছে। তবে মঙ্গলবার প্রচারিত ত্রিপুরার কৈলাশহরের বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ বাংলা সূত্র থেকে জানা যায়, বিজিবির আপত্তির মুখে কৈলাশহরের শ্মশানঘাট এলাকায় ভারতীয় অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ ৪ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরীফপুর সীমান্তের বিজিবি সূত্র এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তারা যখন বাংলাদেশ অংশে মনু প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজে বাধা দিয়েছে, আমরাও তাদের অংশের কাজে বাধা দিয়েছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালিদ বিন অলীদ বলেন, ভারতীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও তাদের বাঁধ অযৌক্তিক। ইতিমধ্যে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কলকাতায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হলেও এখন সমাধান হয়নি। এ অবস্থায় মনু নদীর বাংলাদেশ অংশে বাঁধে পাথরের ব্লক স্থাপন ও কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের মকাবিল এলাকার ভাঙা বাঁধ মেরামত করা যাচ্ছে বিএসএফের আপত্তির কারণে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টিবাদল শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। বর্ষায় ভারি বৃষ্টি হলেও উজানের ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানিতে মনু নদী ভরে উপচে পানি প্রবেশ করে বাংলাদেশ সীমান্ত গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।