নিয়ম অনুসারে কোনো হাসপাতালে অন্তত ৪৫ ভাগ শয্যা নারী ও শিশু রোগীদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ১ হাজার ৩৫০ শয্যার হলেও সেখানে শিশু রোগীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ১৬০টি শয্যা। নারী রোগীর জন্য রয়েছে আরও কমÑ মাত্র ১২০ শয্যা। বাকি শয্যাগুলোতে রোগীর চাপ পর্যাপ্ত থাকলেও নেই পর্যাপ্ত কনসালটেন্ট। গাইনি, শিশু, সার্জারি ও মেডিসিন বিভাগের তিন শিফট মিলিয়ে অন্তত ৯০ জন কনসালটেন্ট থাকার কথা থাকলেও রয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন। তারাও ডিউটি করেন মাসে মাত্র তিন থেকে চার দিন। তবে বেশির ভাগ বিভাগেই রয়েছে পদের অতিরিক্ত চিকিৎসক, যারা কোনো কাজ না করেই মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছেন। ফলে এখানে আসা বেশির ভাগ রোগীই পায় না বিশেষজ্ঞ সেবা। বেশি গুরুতর রোগীকে ভর্তি না করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এসব কারণে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাতে হয় এখানে কর্মরত চিকিৎসকদেরও, যারা চিকিৎসাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সবচেয়ে আতঙ্কের হাসপাতালটিতে বাতাস চলাচলের জায়গায় বানানো হয়েছে ‘লিনেন গোডাউন’, যা থেকে আবারও আগুন লাগার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। হাসপাতালটিতে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও। রাত হলে কেবিন বা পেয়িং বেডগুলোতে বহিরাগতদের আনাগোনায় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের।
মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলীর হাসপাতালটি দেখলে মুগ্ধ হবে যে কেউ। শক্ত ভিত্তি আর দৃষ্টিনন্দন ভবন হলেও পুরো হাসপাতালে নেই প্রতিবন্ধী মানুষ বা রোগী বহনকারী স্ট্রেচারের জন্য কোনো র্যাম্প। হাসপাতালের চার কোনায় চারটি সিঁড়ি থাকলেও নেই পর্যাপ্ত লিফট। দিনে প্রায় ৪ হাজার মানুষের চলাচলের জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি লিফট। বছরখানেকের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে আইসিইউ-২। নতুন করে চালু করার কথা থাকলেও তা না করে এটিকে বানানো হয়েছে এইচডিও। ফলে মৃতপ্রায় রোগীদের প্রয়োজন থাকলেও দেওয়া যাচ্ছে না আইসিইউ সেবা। শুধু তাই নয়, হাসপাতালজুড়ে নতুন নতুন কেবিন হলেও লবিংয়ের জোর না থাকলে পাওয়া যায় না সিটও। ফলে রোগীদের ভোগান্তির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটির তৃতীয় তলায় দুই ভবনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় যেখানে বাতাস চলাচলের জন্য রাখা প্রয়োজন, সেখানে গোডাউন করে হাসপাতালের সব লিনেনের পর্দা জড়ো করে রাখা হয়েছে। এর আগেও আগুন লাগার ঘটনায় হাসপাতালটির কর্মীরা এই রুম নিয়ে রয়েছেন আতঙ্কিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয় বলেন, ছয় বছর আগে এরকমই একটি স্টোররুম থেকে হাসপাতালে আগুন লাগে। এখানে অনেক রোগীর স্বজনেরা রাতের বেলায় লুকিয়ে সিগারেট খেতে আসে। লিনেন কাপড়ের গোডাউন হওয়ায় যেকোনো সময় আবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
শুধু তাই নয়, হাসপাতালটির একেকটি লিফটের সামনে রোগী ও তাদের স্বজনদের লম্বা লাইন দেখা যায়। জরুরি বিভাগের পেছনে লিফটের সামনে মিনিটে মিনিটে জড়ো হয় ২০ থেকে ৫০ জন রোগী ও তাদের স্বজনেরা। রোগী, রোগীর স্বজন, চিকিৎসকসহ বর্জ্য বহনকারী ট্রলি, ময়লা-আবর্জনার ঝুড়ি, খাবারের ট্রলি, এমনকি রোগীর স্ট্রেচার নিয়েও আয়ারা দাঁড়িয়ে আছেন একই লাইনে। লিফটের ভেতরে কোনো ফ্যান দূরে থাক, বাতাস চলাচলেরও কোনো বাড়তি সুবিধা নেই। ফলে মানুষের শরীরের গন্ধের পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনার গন্ধে লিফটে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় উল্লেখ করে হাসপাতালটির আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন বলেন, যতটা কষ্ট না আইসিইউর সামনে ডিউটি পালন করতে গিয়ে করছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে লিফটে ওঠানামা করতে গিয়ে। এত সুন্দর একটা হাসপাতাল, অথচ লিফটে উঠলে মনে হয় ময়লার বাগাড়ে উঠলাম।
ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টার বা ওসেক নামে এখানে জরুরি সেবা চালু থাকলেও নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ইন্টার্নি আর মেডিকেল অফিসার দিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় চলে এখানে চিকিৎসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির এক চিকিৎসক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি নিজে বাইক এক্সিডেন্ট করলে লোকজন এখানে নিয়ে আসে। আমার পরিচয় দেওয়ার পরও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাকে চিকিৎসা দিতে আসেননি। অথচ জরুরি বিভাগে চারজন করে কনসালটেন্ট থাকার কথা। মাঝে মাঝে একজন থাকেন, যারা আবার দুই-তিন ঘণ্টার বেশি সময় দেন না। আমি নিজে হাসপাতালটির চিকিৎসক হয়ে দেখেছি অনেক গুরুতর রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলসহ অন্য বড় হাসপাতালে। এমন অবস্থায় তো একটা হাসপাতাল চলতে পারে না। এখানকার জরুরি বিভাগে কোনো শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় না। সরাসরি ইনডোরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা কেন চলবে?’
খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরকে সাধারণ পোশাকে সেবা নিতে গিয়ে বিব্রত হতে হয়েছে। তার পরিদর্শনের সময় কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাননি উল্লেখ করে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালটিতে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। কিছু অভিযোগ পেয়েছি, যেগুলোর বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। বাকিগুলোও নেবে বলে আমরা আশা করছি।’ এর সত্যতা নিশ্চিত করে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. শফিউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের এখন আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট নেই। মহাপরিচালকের পরিদর্শনের সময় যেসব সংকট পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা হয়েছে।’ হাসপাতালের ভ্যান্টিলেশনের জায়গায় লিনেন রুম কেন বানানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান।
হাসপাতালটিতে রাতের বেলায় নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই অভিযোগ করে হাসপাতালের ষষ্ঠতলার একটি পেয়িং বেডের এক রোগীর মেয়ে বলেন, সারা দিন রোগী নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে রাতের বেলায় যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিই, তখনই দেখতে পাই বিছানার নিচে একজন অপরিত লোক বসে আছে। পরে চারপাশে তাকিয়ে দেখি আরও কয়েকজন অপরিচিত লোক ঘোরাফেরা করছে। রোগীর চিকিৎসা করাব, না নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করব তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে এখানে। একই অভিযোগ করেন হাসপাতালটির কেবিন ব্লকের কয়েকজন রোগীর স্বজনও। তারা বলেন, রাত হলে গেটে তালা দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে অচেনা লোকদের কথা বলতে দেখা যায়। যারা এখানে চিকিৎসাও নিচ্ছেন না বা কোনো রোগীর স্বজনও না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তাই নিরাপত্তা আরও জোরদার করার তাগিদ তাদের।
জানা যায়, ১ হাজার ৩৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বেশির ভাগ সময়ই এখানে ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি থাকে। প্রতি রোগীর সঙ্গে যদি একজন করেও সহযোগী থাকে, তাহলে প্রায় ৩ হাজার। এর বাইরে নতুন ৭০টি কেবিনসহ পুরাতন কেবিন রয়েছে আরও ১৮টা। অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির সার্বিক পরিচালনব্যবস্থা নিয়েও। এখানে সর্বত্র অনিয়ম ছড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ করেন হাসপাতালে কর্মরত একজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মী বলেন, করোনার আগে হাসপাতাল যেমন ছিল, এখন আর তেমন নেই। সব জায়গায় অনিয়ম। গরিব রোগীদের জন্য বিনা মূলে টেস্ট করার কথা থাকলেও এখানে টেস্টের জন্য ফি নেওয়া হয়। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিশাল দুর্নীতি হাসপাতালের পরিচালকের নেতৃত্বে হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এখন এসব দেখার কেউ নেই। এটা যেন মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। কয়েকটি বিভাগ আছে, যেখানকার চিকিৎসকেরা কক্ষেই নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন বন্ধুবান্ধব মিলে। আর নোংরা-আবর্জনা তো চোখেই দেখছেন। পরিচালক একজন নামেমাত্র থাকলেও তার যেন দায় নেই এই হাসপাতালের জন্য।