বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাতারকে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার কাতারের দোহায় আর্থনা সামিটের সাইড লাইনে আয়োজিত রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এই আহ্বান জানান। কাতার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাতার আমিরের বোন ও আর্থনা সামিটের আয়োজক শেখ হিন্দ বিনতে হামাদ আল থানি এই আলোচনায় অংশ নেন।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থান বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ এবং এটি রোহিঙ্গাদের হতাশ করে তুলেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং অবৈধ অভিবাসনের প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে হতাশার স্পষ্ট লক্ষণ। এ সমস্যা আরও অব্যাহত থাকলে তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং উন্নয়ন উদ্যোগকে বিপন্ন করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভূত নানা সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গা সংকট থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কাতার তার সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নতুন আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কাতার এই সমস্যা সমাধানে দৃঢ়ভাবে সংহতি প্রকাশ করতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে ওআইসি দেশগুলোকে আরও তহবিল সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ প্রয়োগে সম্পৃক্ত করতে সক্রিয় হতে পারে। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন, আমরা নিশ্চিত করি যে আজকের আলোচনা যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ না হয়, বরং একটি অর্থবহ অংশীদারত্বের সূচনা হয়, যা রোহিঙ্গা সংকটকে আমাদের অভিন্ন মানবিক অগ্রাধিকারগুলোর অগ্রভাগে রাখবে এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। আসুন, আমরা মানবতার জন্য, স্থিতিশীলতার জন্য এবং ন্যায়বিচারের জন্য একসাথে কাজ করি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) চলমান বিচার ও জবাবদিহির উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্ত এবং ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ ও রোম সংবিধির রাষ্ট্রীয় দল হিসেবে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো অপরাধ কখনো বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। রাখাইনে প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরিতে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের দায়ী করাও হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আইসিজেতে বিচারাধীন চলমান বিচারিক কার্যক্রমের ব্যয় মেটাতে বাজেটের গুরুতর সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে ওআইসির বিত্তশালী সদস্য হিসেবে কাতারকে রোহিঙ্গাদের জন্য গঠিত ওআইসি তহবিলে আর্থিক অবদান রাখার জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি রাখাইনের পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। আরাকান আর্মি এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এবং রাখাইনের ১৭টি শহরের ১৪টি নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাখাইনের মোট অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭৬। এর মধ্যে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭১ জন রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা ২১টি দীর্ঘস্থায়ী শিবির ও তিনটি গ্রামে রয়ে গেছে। এ ছাড়া ১ হাজার ২১৯টি স্থানে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮০৫ জন (যাদের বেশির ভাগই রাখাইন) নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা এই অঞ্চলে চলমান মানবিক সংকটের প্রতিফলন। মিয়ানমারের চলমান সশস্ত্র সংঘাতের কারণে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আরাকান আর্মির হামলায় আক্রান্ত হয়ে মিয়ানমারের ৯০৯ জন নিরাপত্তা সদস্য স্বেচ্ছায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৭৫ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে এবং শিগগিরই আরও ৩৪ জনকে ফেরত পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, রোহিঙ্গা মানবিক সংকটে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) আওতায় অর্থায়ন কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি, জেআরপির বৃহত্তম দাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস করেছে, যা তহবিলের বিদ্যমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সম্প্রতি ডব্লিউএফপি ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিলে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। অবশেষে, ডব্লিউএফপি কিছু তহবিল পরিচালনা করতে পারে এবং তহবিল কাটা এড়াতে পারে। তবে ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা না গেলে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবারও তহবিল সংকটে পড়বে তারা। তহবিলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে কাতার।