আগামী ২৭ এপ্রিল সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পূর্ণাঙ্গ কার্গো কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এটি ঢাকার পর দ্বিতীয় কোনো বিমানবন্দর, যেখান থেকে আন্তর্জাতিক কার্গো সার্ভিস শুরু হবে। এর মধ্য দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত হওয়ার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে সিলেট।
বলা হচ্ছে, এই সুযোগ বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে সিলেট যেমন লাভবান হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিমান সংস্থাগুলোকে সিলেট থেকে ফ্লাইট পরিচালনায় উৎসাহ প্রদান করবে। সিলেটের জন্য এটি বিশাল একটি ইতিবাচক সুযোগ নিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক ও পরিচালক হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পূর্ণাঙ্গতার প্রশ্নে এক ধাপ এগিয়ে গেল। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি অব্যাহত থাকলে সিলেট থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যবসার দুয়ার উন্মুক্ত হবে। একে কাজে লাগতে পারলে সিলেটের ব্যবসায়ীরা দারুণভাবে লাভবান হবেন।
অবশ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এখনো বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত না হওয়ায় এখনই এটি শতভাগ পূর্ণাঙ্গতা পাচ্ছে না। এর জন্য আরও কিছুদিন সিলেটকে অপেক্ষা করতে হবে। শতভাগ পূর্ণতার ক্ষেত্রে বিলম্বের মূল কারণ কাজের দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতি। পাশাপাশি সিলেটের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণও এর জন্য অনেকটা দায়ি। বিদেশি এয়ারলাইনস সিলেটে ওঠানামার সব সুযোগ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ঢাকায় বসা সিভিল অ্যাভিয়েশন ও বিমান বাংলাদেশের অসাধু কর্মকর্তাদের আপত্তির কারণেই তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং পিছিয়ে থাকছে সিলেট।
ব্রিটেনের বিশিষ্ট আইনজীবী ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ড. নাজির আহমদের প্রশ্ন, সিলেট এম এ জি ওসমানী বিমানবন্দরকে সত্যিকার অর্থে ও পূর্ণাঙ্গভাবে আন্তর্জাতিক করতে অসুবিধা কোথায়? কেন করা হচ্ছে না? যুগের পর যুগ ধরে শুনে আসছি রানওয়ে দীর্ঘ করা এবং রিফিউলিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা, কিন্তু কেন এখনো করা হচ্ছে না? রিফিউলিং আর রানওয়ে বড় করার কিচ্ছা আর কত দিন শুনব? তার মতে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও দুর্নীতিবাজ লোক ও গোষ্ঠীর কারণে সিলেট এম এ জি ওসমানী বিমানবন্দর সত্যিকার অর্থে ও পূর্ণাঙ্গভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে উঠছে না। এর ফলে বহির্বিশ্বে থাকা সিলেটের যাত্রীরা অযথা বৈষম্য ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ গাজী বলেন, ওসমানী বিমানবন্দর নামে আন্তর্জাতিক হলেও কাজে এখনো আন্তর্জাতিক হয়নি। একমাত্র বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়া অন্য কোনো এয়ারলাইনসকে ওসমানীতে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতি সপ্তাহে বিমান ছাড়াও সাতটি বিদেশি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ওঠানামা করছে। বাংলাদেশ সরকার ও সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি সিলেটবাসীর সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।
বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক ও পরিচালক হাফিজ উদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সিলেট এয়ারপোর্ট ‘পূর্ণাঙ্গ নয়’ এটি ঠিক নয়। সিলেট আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর। কোথাও পূর্ণাঙ্গতার কোনো ঘাটতি নেই। সক্ষমতা আছে। বিদেশি বিমানগুলো যাত্রীর চাহিদা বিবেচনা করে ফ্লাইট চালু করতে পারে। সব সুযোগ এখানে নিশ্চিত রাখা হয়েছে। তিনি জানান, পূর্ণাঙ্গতা দিতে কিছুদিন আগে সিলেট এয়ারপোর্টে চালু হয়েছে প্রবাসী লাউঞ্জ।
সিভিল অ্যাভিয়েশন সূত্র জানায়, ১৯৪৪ সালে সিলেট বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর আতাউল গনি ওসমানীর সম্মানে নামকরণ করা হয় সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর। ২০০২ সালে ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সিলেটবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের পর লন্ডন-সিলেট রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়। অনেকবার এই ফ্লাইট বন্ধও হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নাম থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে বিমানের সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সিলেটবাসীর মধ্যে হতাশা ছিল। আবার আন্দোলন করার পর চালু হয়। ২০১০ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই বিমানবন্দরে একটি রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বিমানবন্দরে নির্মিত হয় তিনটি স্টোরেজ ট্যাংক, হাইড্রেন্ট লাইন, ডিপো রিফুয়েলার ডিসপেনসার ও ফিল্টার এবং জেট ফুয়েল পরিবহনের জন্য ব্রিজার অর্থাৎ বড় ট্যাঙ্ক লরি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে পদ্মা ওয়েলের তত্ত্বাবধানে ৫১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে শুরু হয় রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের কাজ। ২০১৩ সলের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়।
সূত্রমতে, দীর্ঘ কয়েক মাস সিলেট থেকে দুবাই ফ্লাইট পরিচালনা করে। পরে অজ্ঞাত অজুহাতে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে আর কোনো বিদেশি ফ্লাইট সিলেটে এসে নামছে না, উড়ছেও না। তবে এর মাঝে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় জরুরি ভিত্তিতে সিলেটে অবতরণ করে আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এতে প্রমাণিত হয়, সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চাইলে বিদেশি যেকোনো এয়ারলাইনস নামতে ও উঠতে পারবে। এরপর থেকে ঘন কুয়াশার সময়ও অনেক বিদেশি ফ্লাইট সিলেটে অবতরণ করানো হয়। ওসমানী বিমানবন্দরকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর শতভাগ নিশ্চিত করলে বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইন বিমান বাংলাদেশের পাশাপাশি ব্রিটিশ, তুরস্ক, কাতার, আমিরাত, দুবাই, ওমান, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চালু করার সুযোগ তৈরি হবে। এতে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া হ্রাস এবং ঢাকা ও সিলেটের মধ্যে বিমানের ভাড়ার পার্থক্য দূরসহ কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সেকশনে প্রবাসী যাত্রীদের অহেতুক হয়রানি বন্ধ হবে।
সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গতা দিতে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথক সাবস্টেশন স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, যাত্রীদের জন্য এস্কেলেটরসহ অনেক কাজ হয়েছে। কার্গো হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা ৪০ হাজার টন থেকে ১ লাখ টনে উন্নীত করা এবং বছরে ৬ লাখ থেকে উন্নীত করে ২০ লাখ যাত্রীসেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য এয়ারলাইনস অবতরণের জন্য এয়ার স্পেস ওপেন স্কাই লাইসেন্সটি এখন পর্যন্ত ইস্যু করা হয়নি। এই লাইসেন্স প্রদান করা হলে অন্যান্য এয়ারলাইনস অবতরণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
প্রবাসীদের অভিযোগ, সিলেটে বিমানের চেক ইন কাউন্টারে প্রতিনিয়ত যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি লাগেজ ও মালামাল চুরি এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। গেল সোমবারও দুবাই থেকে আসা বিমানের একাধিক যাত্রীর লাগেজ থেকে মালামাল সম্পূর্ণ চুরি হয়ে গেছে। অতীতের সব সরকারই সিলেটবাসীর এসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেও এর বত্যয় হচ্ছে না। এসব নানান কারণে নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা বাংলাদেশে না গিয়ে তুরস্ক, মরোক্কো, মিশর ও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে হলিডেতে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সন্তানেরা দেশমুখী হচ্ছে না এবং বাংলাদেশ বিরাট অঙ্কের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :