ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫

ইন্টারনেটের ৪ স্তর বাদ যাচ্ছে নতুন নীতিমালায়

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ১২:২২ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থার চারটি স্তর বাদ দেওয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থার সংস্কার নীতিমালা-২০২৫’ এর খসড়ায়। এই স্তরগুলো হচ্ছে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (নিক্স), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি)। পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন পর্যায়কে বর্তমানের তুলনায় কম ‘রেগুলেটেড’ করে খসড়া নীতিমালা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর অংশ হিসেবে কল সেন্টার, ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সেবা এবং টেলিকম খাতের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (টিভ্যাস) সেবাগুলো দিতে আর লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা থাকছে না।
 
অন্যদিকে থানা বা উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা প্রদান, এসএমএস এগ্রিগেটর এবং ভিস্যাট সেবা শুধু ‘এনলিস্টমেন্ট’ নিয়েই দেওয়ার সুযোগ রেখেছে বিটিআরসি। এসব সহ মোট ১১টি অনুচ্ছেদে গত সোমবার নিজেদের ওয়েবসাইটে খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে কমিশন। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে নীতিমালা সম্পর্কে জন সাধারণের মতামত গ্রহণ করা হবে। তবে দেশের টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে খসড়া নিয়ে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
 
বর্তমানে সাবমেরিন কেব্ল লাইসেন্স এবং ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল কেব্ল (আইটিসি) লাইসেন্সকে ইন্টারন্যাশনাল কানেকটিভিটি সার্ভিস লাইসেন্সে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। তেমনি ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স এবং টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্সকে ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেকটিভিটি সার্ভিস লাইসেন্সে; সেলুলার মোবাইল টেলিকম অপারেটর লাইসেন্সকে সেলুলার মোবাইল সার্ভিস লাইসেন্সে; পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন), জাতীয়, বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোডাইডার (আইএসপি), এনজিএসও (নন-জিও স্টেশনারি অরবিট), ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিফোনি সার্ভিস প্রোভাইডর এবং স্যাটেলাইট অপারেটর লাইসেন্সগুলোকে ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস লাইসেন্সে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি থানা বা উপজেলা পর্যায়ের আইএসপি, এসএমএস এগ্রিগেটর এবং ভিস্যাট সেবা শুধু ‘এনলিস্টমেন্ট’ নেওয়ার মাধ্যমেই দেওয়া যাবে। বিশেষ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) সেবাকে। লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কল সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনা, ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং টিভ্যাস সেবাকে। অর্থাৎ লাইসেন্স ছাড়াই খসড়ায় এসব সেবা দেওয়ার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
 
খসড়া প্রস্তাবনার বিভিন্ন বিষয়কে সাধুবাদ জানিয়েছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি এবং টেলিকম খাত সংশ্লিষ্টরা। আবার কিছু সেবার জন্য লাইসেন্স একেবারেই তুলে দেওয়া বা সহজতর করার ক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। কিছু সেবার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি আলমাস কবীর বলেন, ‘ডি-রেগুলেশন’ যেকোনো ব্যবসার প্রসারের জন্য সুবিধাজনক। কিছু সেবাকে লাইসেন্সের মতো অপেক্ষাকৃত কঠিন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। তবে একেবারেই কোনোকিছু না থাকার চেয়ে কিছুটা জবাবদিহিতা থাকা উচিত। এজন্য ন্যূনতম রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন এবং এনলিস্টমেন্টের ব্যবস্থা রাখা যায়।
 
অন্যদিকে উপজেলা পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সেবা দিতে শুধু ‘এনলিস্টমেন্টে’র সুবিধায় আপত্তি জানিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি ইমদাদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই সিদ্ধান্তে উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবসায় অনেক বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। পাশাপাশি সেখানকার আইএসপিদের ওপর বিভাগীয় বা জাতীয় পর্যায়ের আইএসপির নির্ভরতা বাড়বে। আইজিডব্লিউ, আইসিএক্সের মতো স্তর তুলে দেওয়ায় এসব মাধ্যমে আসা কল মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা (এমএনও) পাবে অর্থাৎ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে। খরচ সাশ্রয়ের জন্য আইআইজি স্তর বাদ দেওয়া হচ্ছে। অথচ সাবমেরিন ক্যাবল, আইটিসি, নিক্স এবং ক্যাশ সার্ভিসকে একত্র করে আইএসপিকে ‘বেস্ট রাউট’ দেয় আইআইজি। অনেক আইএসপির এই সক্ষমতা নেই। অথচ রেভিনিউ শেয়ারিং উঠিয়ে দিলেই ইন্টারনেট সঞ্চালনের খরচ অনেক কমিয়ে আনা যেত। এই প্রস্তাবনার অনেকক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
 
লাইসেন্সবিহীন ব্যবসার সুযোগের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অনেক সেবা দেওয়া যায়। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ফুড ডেলিভারি করে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে রেগুলেট করতে চাই না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ওই সেবা দিতে হয়তো একটা সিম ব্যবহার করে। সিম কোম্পানি কিন্তু রেগুলেশনের মধ্যে আছে। ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান কোনো অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অন্য সংস্থা আছে। অর্থাৎ সবাইকে নির্দিষ্ট করে টেলিকম সেবার মধ্যে রেগুলেট করছি না। শুধু এনলিস্টমেন্ট এর মাধ্যমে উপজেলা আইএসপিদের ব্যবসার ক্ষেত্রে গ্রাহক স্বার্থবিষয়ক অভিযোগ উঠলে বিটিআরসি কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারবে এমন প্রশ্নের জবাবে এমদাদ বারী বলেন, যেসব বিষয়ে সংস্কার করছি, তার মধ্যে সবথেকে জটিল হচ্ছে আইএসপি খাত। এই খাতের যারা নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ আইএসপিএবি, তারা এটিকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করতে পারেননি।
 
আইএসপিএবিতে যারা নেতৃবৃন্দ আছে তারা মূলত জাতীয় পর্যায়ের আইএসপি ব্যবসায়ী। তাদের স্বার্থ স্থানীয় পর্যায়ের আইএসপি ব্যবসায়ীর স্বার্থের মতো না। আবার টেলিকম খাতে লাইসেন্স গ্রহীতার যে সংখ্যা বলা হয়, তার সিংহভাগ এই আইএসপি লাইসেন্স। এক সপ্তাহে ৪০০ আবেদন নিষ্পত্তি করেছি। এখনো শত শত আবেদন জমা পড়ে আছে আইএসপি লাইসেন্স নেওয়ার জন্য। আইএসপি খাতে লাইসেন্স কমানোর জন্য তাদের এনলিস্টমেন্টের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে এনলিস্টমেন্ট নেওয়া আইএসপি কিন্তু জেলা, বিভাগীয় বা জাতীয় পর্যায়ের আইএসপির সাথে যুক্ত থাকবে। গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষায় তাদের জবাবদিহিতার সুযোগ বিটিআরসির থাকবে।
 
খসড়াতে এই নীতিমালার সাতটি উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ সহজ নেটওয়ার্ক ‘টপলোজি’ তৈরি, ব্যবসাবান্ধব এবং সৃজনশীলতামূলক লাইসেন্সিং মডেল গড়ে তোলা, সেবা ও প্রযুক্তিগত নিরপেক্ষতার প্রসার, টেলিযোগাযোগ সেবায় ভোক্তার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। এছাড়াও তিনটি ধাপে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে খসড়ায়। প্রথম ধাপে নীতিমালার কার্যকারিত শুরু, দ্বিতীয় ধাপে নতুন লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া শুরু এবং তৃতীয় ও শেষ ধাপে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে নতুন নীতিমালার আলোকে ক্যাটেগরি গ্রহণ করাই হবে একমাত্র পন্থা। নতুন লাইসেন্সিং এবং নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থায় টেলিকম সেবার খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়বে বলে প্রত্যাশা নীতিমালা প্রণয়ন সংশ্লিষ্টদের।