শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ১১:২১ পিএম

দালালে দিশাহারা রোগীরা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ১১:২১ পিএম

দালালে দিশাহারা রোগীরা

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ পূর্ব এলাকার বাসিন্দাদের রোগে-শোকে ভরসার নাম মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫শ শয্যার হাসপাতালটিতে পাওয়া যায় প্রায় সব ধরনের রোগের চিকিৎসাসেবা। করোনার সময় থেকেই হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবার ওপর মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে ডেঙ্গু রোগীদেরও ভরসার স্থল হয়ে উঠে এটি। কিন্তু দিন দিন হাসপাতালটিতে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। 

হাসপাতাল থেকে বেসরকারি কোনো ডায়াগনস্টিকে রোগী ভাগিয়ে নিতে তাদের তৎপরতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে দিন দিন। এমনকি সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের ওষুধও তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া পাচ্ছেন না রোগীরা। হাসপাতালে শয্যা পাওয়া থেকে শুরু করে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত রোগীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনেই হাসপাতালটি থেকে ৫ জন নারীসহ ২২ দালালকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এদিন সরেজমিনে হাসপাতালটিতে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে রক্ত দিতে এসেছেন এক যুবক। এক দালাল তাকে টাকার বিনিময়ে রক্ত দিতে নিয়ে এসেছেন জানিয়ে ওই যুবক বলেন, আমি একটি ফার্মেসিতে চাকরি করি। এখানে রক্ত দিতে এসেছি। ঠিক তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাকে আটক করতে দেখা যায়। কেন তাকে আটক করেছেন জানতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য জানান, সে এখানে আসা রোগীদের জিম্মি করে রক্তের বাণিজ্য করে। টাকার বিনিময়ে রক্তদাতা এনে দেয়। 

শুধু এই যুবক নয়, এদিন হাসপাতালটির জরুরি বিভাগ-বহির্বিভাগ থেকে আটক করা হয় সুমাইয়া আক্তার, আজাদ শেখ, আজিজুর মুন্সি, আবুল বাসার, আশিক আহম্মেদ, ইলিয়াস, ওহিদুজ্জামান, জীবন ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, মোসা. ফারজানাসহ ২২ জনকে। তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে কেউ কেউ রোগীদের প্রভাবিত করে বিনা মূল্যের ওষুধ না কিনে পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করে। কেউ আবার হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে অন্য বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য রোগীদের নিয়ে যায়। 

এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী অভিযান চালালে মোট ৩২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ২২ জনের বিরুদ্ধে দালালির স্পষ্ট প্রমাণ মেলায় তাদের ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের আটকের বিষয়ে ডিএমপির স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহিদুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, হাসপাতালটিতে অনেকদিন ধরেই দালালদের দৌরাত্ম্য চলছিল। তারা মূলত স্থানীয় হওয়ায় কেউ সহজে মুখ খুলতে সাহস করত না। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য পেয়ে আমরা আজ অভিযান চালিয়ে এদের আটক করেছি। এমন অভিযান নিয়মিতভাবে চলবে। 

আটকের পরও তাদের ঔদ্ধত্য আচরণ ছিল লক্ষ্যণীয়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আটক আশিক আহম্মেদ বলেন, আমাদের আটক করেছে তো কি হয়েছে। ১৫ দিনেরই তো ব্যাপার। তারপর দেখা যাবে। একই রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখা যায় আরও অনেকের মধ্যেই।

এসময় আটক এক দালাল বলেন, তার বাড়ি পাশের একটি বস্তিতে। কোনো কাজ করেন না। তাই তিনি হাসপাতালে এসে রোগীদের সেবা পাইয়ে দিতে আয় করার পথ বেছে নিয়েছেন। তার বিবরণ থেকে জানা যায়, অনেক রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসেন, তারা হাসপাতালের কোন ভবনে কী, কোথায় কী করতে হবে। ভর্তির প্রক্রিয়া, ল্যাবে পরীক্ষার কাজ করতে পারেন না। অথবা চিকিৎসকের রুমেও বিড়ম্বনায় পড়েন। কিন্তু তিনি কাজটি স্বাভাবিকভাবে করে দিয়ে কিছু টাকা নেন। এর মাধ্যমে তার সংসার চলে। আর হাসপাতালের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। ফলে রোগীর চিকিৎসাসেবায় হয়রানি কম হয় বলে এই দালালের দাবি।

এ সময় এক রোগীর চিকিৎসাসেবার প্রক্রিয়ার খোঁজ করে দেখা যায়, তার ভর্তি ও পরীক্ষার দায়িত্ব নেন হাসপাতালের একজন কর্মচারী। বিনিময়ে তাকে দিতে হয় ৪০০ টাকা। ফলে এক্স-রে করাতে গিয়ে তাকে কোনো লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। সিরিয়ালে ন্যূনতম ২০ জন রোগী থাকলেও এই রোগীকে নিয়ে দালাল সরাসরি এক্স-রে রুমে চলে যান। সেখানে সব প্রক্রিয়া শেষ করে দেন। অবশ্য এজন্য এক্স-রে রুমের সংশ্লিষ্টদের আরও ১০০ টাকা দিতে হয়। এভাবে দালালদের মাধ্যমে যেসব রোগী ভেতরে আসে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন তারা।

হাসপাতালে কথা হয় এই রোগীর স্বজন শিপন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে থেকে তিনি শুনেছেন সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে পদে পদে হয়রানি। এখানে  দালালদের দৌরাত্ম্য। তাই তিনি একজন কর্মচারীকে দিয়ে চিকিৎসা প্রক্রিয়া ত্বরান্তিত করেছেন।

শুধু দালালদের দৌরাত্ম্য নয়। হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পোহাতে হয় আরও নানা ধরনের দুর্ভোগ। অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালেই কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে হাসপাতালটিতে আসা বেশির ভাগই বিনা মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে পারছেন না। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অনিরাপদ অবস্থায় রেখে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা। হাসপাতালের ভেতরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা। তার মধ্যে জমে রয়েছে পানি। যেখান থেকে সহজেই ডেঙ্গু জন্ম নিতে পারে।

সরেজমিন হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, বেডের পাশাপাশি মেঝেতে রেখেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত এই রোগীদের হাতেগোনা কয়েকজনকে মশারি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই কোনো মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

হাসপাতালের ভেতর ময়লা পরে থাকার বিষয়ে বিরক্ত এখানে কর্মরত ডাক্তার-নার্সরাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, সত্যি কথা বললে নিজেদের বদনাম নিজেদেরই করতে হয়। এই হাসপাতাল বাইরে থেকে দেখতে ফিটফাট কিন্তু ভেতরে সদরঘাট। হাসপাতালের ভেতরে ময়লা পড়ে থাকা সাধারণ ঘটনা। কিছুদিন আগেও ওয়ার্ডের বেডে বেডে একাধিক তেলাপোকা বিচরণ করত। রোগীদের দুর্ভোগ প্রতিদিনের ঘটনা। স্থানীয় কিছু ক্লিনিক থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পরীক্ষার ক্ষেত্রে রোগীদের হয়রানিও করা হয়।

তিনি আরও বলেন, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ফ্রি। এ কারণে গরিবরা ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে সরকারি হাসপাতালে ছুটে আসে। কিন্তু এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে থেকেও ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না। যে কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে পকেটের টাকা খরচ করে বাইরে থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছেন।

রাজধানীর গোড়ান থেকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে আসা আনিসুর রহমান বলেন, সকাল ৮টার সময় ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলাম ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে। এখন বাজে দুপুর ১২টা। এখনো সিরিয়াল পাইনি। দুই একজন দালাল এসে ঘুরে গেছে। বলেছে ১শ টাকা দিলে লাইন ছাড়াই পরীক্ষা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু আমি তাদের পাত্তা দেইনি।

একইরকমভাবে দীর্ঘদিন লাইনে থেকে ক্লান্ত অবস্থায় জরুরি বিভাগের সামনের বেঞ্চে বসে আছেন মায়া সাহা। বলেন, পুরান ঢাকা থেকে এসেছি এখানে ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু এত লম্বা লাইন বহির্বিভাগে যে আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাই বসে আছি। 

সকালে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলেই নিচতলায় চোখে পড়ে টিকিট কাউন্টার। তিন দিকেই মানুষের সিরিয়াল। টিকিট তো নয়, মনে হবে ত্রাণের সিরিয়াল। ভোরে এসে সিরিয়াল ধরে টিকিট নিয়ে দিনে দিনে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরা কঠিন।

রোগীরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে আস্থা বেশি। তাই আমরা আসি। কিন্তু সিরিয়ালেই কষ্ট। টিকিটে সিরিয়াল, চিকিৎসক দেখানোয় সিরিয়াল, আবার টেস্ট দিলে তো কথাই নেই। ওটা আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। টিকিট কেটে রোগী দেখানো যায় দিনে দিনে, কিন্তু পরীক্ষা দিলে আরও দু-একদিন আসা লাগবেই।

সক্ষমতার চাইতে রোগী বেশি হওয়ার কারণেই এ সমস্যা উল্লেখ করে হাসপাতালটির পরিচালক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মেজবাহুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারি হাসপাতাল কাউকে তো ফেরানোর সুযোগ নেই। সাধ্যমতো সবাইকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। সেবাবিহীন কেউ থাকে না। তবে, ভোগান্তির যে অভিযোগ সেটাও অসত্য নয়, সক্ষমতার চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি রোগী সামাল দিতে হয়। ভোগান্তি তো কিছুটা হবেই। দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে আমি নিজেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আমিই জানিয়েছি। অভিযান নিয়মিতভাবেই চলে আমাদের। তবে এক দিনে তো সমাধান সম্ভব নয়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!