পহেলগাম ঘটনায় কার্যত স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হামলার নিন্দা করা হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এ হামলার পর ভারত সরকার ও মিডিয়া যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তাতে ইসরায়েলের গাজা অভিযানের মতো ‘প্রতিশোধমূলক নীতি’ অনুসরণ করতে পারে।
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ঘেরা পহেলগাম এলাকার এক সবুজ উপত্যকায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে পর্যটকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ইতালীয় ও ইসরায়েলি নাগরিকও রয়েছেন। এদিকে কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে এদিন সর্বদলীয় বৈঠক করছে মোদি সরকার।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক দিয়েছেন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহও। ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা স্থগিত, ভারতের বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ এবং দেশটির সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণাসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত জানিয়েছে পাকিস্তান। এদিকে, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে। ২৭ এপ্রিলের মধ্যে তাদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ভারত।
এই হামলার পর পাক সেনাপ্রধানের কাশ্মীরকে ‘পাক ধমনী’ বলে দাবি করেন। সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই এবার তাকে সাবেক আলকায়দা নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সন্ত্রাসী হামলার হোতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তুলনা করলেন সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা মাইকেল রুবিন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে সাবেক এই মার্কিন কর্মকর্তা কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দাও করেন।
ভারত এবং পাকিস্তান দুই পক্ষের একের পর জরুরি বৈঠক, চুক্তি বাতিল, সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, ভিসা বাতিল, কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো প্রতিশোধের পথে হাঁটছে ভারত। ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদসংস্থার দেওয়া খবর অনুসারে, এখন পর্যন্ত জানা গেছে, অন্তত ৬ জন সন্ত্রাসী এই হামলা চালায়।
নিরাপত্তাবাহিনীর দাবি, এই ছ’জনের মধ্যে দু’জন কাশ্মীরি, যারা ২০১৭ সালে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল এবং সম্প্রতি অন্যান্য বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে অনুপ্রবেশ করে ভারতে প্রবেশ করে। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে লস্কর-ই তৈয়েবারও সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সূত্র বলছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকায় প্রায় ৬০ জন সক্রিয় জঙ্গি রয়েছে, যার মধ্যে শুধু লস্করের সদস্যই ৩৫ জন এবং জইশ-ই-মহম্মদের সদস্য ২১ জন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, পহেলগামের ঘটনার পরপরই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রায় ৪২-৪৫টি জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির ও ঘাঁটিকে নির্দিষ্ট করে ফেলেছে দেশের সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, এইসব ঘাঁটিগুলোতে আনুমানিক ১৫০-২০০ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি রয়েছে। খবর ইন্ডিয়া টুডে এবং বিজনেস টুডে। অনন্তনাগের পুলিশ জানিয়েছে, সন্দেহভাজন হামলাকারীরা হচ্ছেন হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। এ ছাড়া আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই- তিনিও পাকিস্তানের নাগরিক। আরেক সন্দেহভাজন হামলাকারী হিসেবে আব্দুল হুসেইন থোকারের নাম জানিয়েছে পুলিশ।
ভারত কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের হত্যাকারী এবং এই হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছে তাদের ছাড় দেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাকিস্তানিদের জন্য বিশেষ ভিসা সুবিধা বাতিল ও ভারতে অবস্থিত পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে পাক সামরিক উপদেষ্টাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে নয়াদিল্লি। এছাড়া দুই দেশের মধ্যকার প্রধান বর্ডার ক্রসিংটিও বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এই উত্তেজনার মধ্যেই বৃহস্পতিবার মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। অন্যদিকে যুদ্ধের আশঙ্কায় পাল্টা প্রস্তুতি চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সীমান্ত লাগোয়া ঘাঁটিগুলিতে সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে পাকিস্তান। সমাজমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়লেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তরফে অবশ্য এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার পর নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগছেন পর্যটকেরা। দিল্লির একাধিক ট্রাভেল এজেন্সির বরাত দিয়ে দেশটির বার্তা সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরগামী প্রায় ৯০ শতাংশ বুকিং বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, মহারাষ্ট্র রাজ্যের স্বরাষ্ট্র বিভাগ মুম্বাই পুলিশকে উপকূলরেখা বরাবর নজরদারি বাড়াতে এবং সম্ভাব্য হুমকি প্রতিরোধে টহল জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি, উপকূলীয় পুলিশ স্টেশনগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। মুম্বাই পুলিশের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘সতর্কতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সমস্ত উপকূলীয় পুলিশ স্টেশনগুলোকে উচ্চ সতর্কতায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই সতর্কতা মুম্বাই ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোর সংবেদনশীল উপকূলীয় পয়েন্টগুলোতে কার্যকর হয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এখন নৌবাহিনী এবং উপকূলরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে পশ্চিম উপকূলজুড়ে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলছে।
আপনার মতামত লিখুন :