ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম সুমনের ক্ষমতার দাপটে তটস্থ থাকত দেশের বিনোদন জগতের সুন্দরী তারকাও। পছন্দ হলেই ডেকে পাঠাতেন বিশেষ স্থানে, একান্তে সময় কাটাতেন। শুধু তাই নয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের কাছেও পাঠাতেন। বিনিময়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ট হওয়ায় ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না কেউ। ডিএমপির প্রভাবশালী গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান হওয়ায় ইচ্ছেমতো প্রভাব খাটাতেন। মিথ্যা মামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করতেন।
দিনে অফিস করতেন রাজধানীর মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) হেডকোয়ার্টারে, রাতে ঘুরে বেড়াতেন রাজধানীর অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেল-রেস্তোরাঁয়। সেখানে সঙ্গি হতেন বিনোদন জগতের তারকা। তাদের সঙ্গে আড্ডার ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। শোবিজ জগতের একাধিক তারকার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গায়ক বেলাল খান ও মডেল-অভিনেতা অন্তু করিমের সঙ্গে মিলে তিনজনের একটি টিম ছিল নাজমুলের। বেলাল খান ও অন্তু করিমের অফিসে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন তারকাদের। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত চলত আড্ডা। অফিস দুটিতে থাকা বিশেষ কক্ষে একান্তে সময় কাটাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বেলাল খান ও অন্তু করিমের সঙ্গে নাজমুলের ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব রয়েছে, বিষয়টি শোবিজ জগতের সবাই জানে। তাদের তিনজনের ঘনিষ্টতার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের কথা শুনতে হয়েছে। নিয়মিত অনুষ্ঠান ও আড্ডায় যেতে হয়েছে ক্ষমতাবান গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভয়ে। বেলাল খান ও অন্তু করিম নাজমুলের প্রভাব দেখিয়ে অনেক তারকাকে হয়রানিও করেছে। ৫ আগস্টের পর বেলাল খান ও অন্তু করিম আড়ালে চলে গেছেন। এখন আর জমজমাট সেই আড্ডা হয় না, গভীর রাতে পার্টিও বন্ধ হয়ে গেছে।
শোবিজ জগতের সুন্দরী নায়িকা-মডেল শিকার করে বেড়াতেন নাজমুল। তাদের জোরপূর্বক নিজে, রাজনীতিবীদ ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিছানাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন। নাজমুলের প্রতারণার এক ভয়ংকর অধ্যায় সামনে এসেছে। আওয়ামী পুলিশ লীগের সক্রিয় সদস্য নাজমুল সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিআইজি হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার সিন্ডিকেটের অন্যতম অনুসারী ছিলেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে ব্যবহার করতেন এই নাজমুল। গত দেড় দশকে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের নানা অপকর্ম ও দুর্নীতি নিয়ে সরব ছিলেন, তাদেরই টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশলে দমন করত নাজমুলের নেতৃত্বাধীন সিটিটিসির ইউনিট। অথচ নাজমুল নিজেই বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বিনোদন জগতেও নাজমুল আতঙ্ক কাজ করত। কারণে অকারণে নায়িকা-মডেলদের ফোন করে দেখা করতে বলতেন। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশাসনের প্রভাবশালীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে বাধ্য করতেন। একজন মডেল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমার সঙ্গে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়। এ ঘটনায় থানায় জিডি করি। মামলা যায় সাইবার ক্রাইম ইউনিটে, এরপর নাজমুল একটি হোটেলে দেখা করতে বলে। প্রায় তিন বছর ধরে তার কথামতো যখন তখন দেখা করতে হয়েছে বিভিন্ন হোটেলে। দেখা করতে না চাইলে জেলে পাঠানোর ভয় দেখাতেন। বাধ্য হয়ে তার কথা শুনতে হয়েছে। একটা পর্যায়ে একজন মন্ত্রী নিষেধ করে দেওয়ায় আমার পেছন ছাড়ে।
নাজমুলের কথা না শুনলে তাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হতো। নাজমুলের ফেসবুক প্রোফাইলে হোটেল-রেস্টুরেন্টে তোলা বিনোদন জগতের অংসখ্য তারকার সঙ্গে সেলফি বা ছবি এখনো রয়েছে। রাত-বিরাতে নায়িকা-মডেলদের সঙ্গে হোটেলে সময় কাটানো এবং লংড্রাইভে যেতেন এমন ছবিও রয়েছে। নাজমুল সঙ্গে একাধিক তারকার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের অডিও রেকর্ড ও ছবি এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। শোবিজ জগতের সুন্দরী তারকাই মূলত নাজমুলের টার্গেট ছিল। কাউকে পছন্দ হলেই তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক করতে উঠেপড়ে লাগতেন। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সুন্দরীদের বিছানা সঙ্গী হতে বাধ্য করতেন।
মডেল-অভিনেত্রী শাকিলা পারভীনের সঙ্গে নাজমুলের বিশেষ সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে শাকিলা পারভীন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, দুই বছর হলো আমার সঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাজমুলের যোগাযোগ নেই। তা ছাড়া পুরোনো বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আরও দুজন ঢাকাই সিনেমার সুন্দরী নায়িকা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দীর্ঘদিন নাজমুলে কথামতো চলতে হয়েছে। ৫ আগস্টের পর হাফ ছেড়ে বেঁচেছি।
নাজমুল ইসলাম সুমন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। সেখান থেকেই কর্মরত ছিলেন একই স্থানে। ৫ আগস্টের পর পট পরিবর্তনের পর ওএসডি করে তাকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলি করা হয়। তবুও বরিশালে যোগদান না করে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। গত মার্চে নাজমুল রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছিলেন, ঊর্র্ধ্বতনদের অনুমতি নিয়েই ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করছি। উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ ‘ছাত্রদলের ট্যাগ লাগাতে কোটি টাকার মিশন!’ শিরোনামে রূপালী বাংলাদেশে নাজমুলের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করা হয়। সে সময় সংবাদ প্রকাশ না করতে নানা মাধ্যমে রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদককে চাপ সৃষ্টিও করেন। এরপর বরিশালে যোগদান করেই আবার ছুটিতে চলে যান।
এদিকে, হত্যাচেষ্টা, প্রতারণা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক উপ-কমিশনার (ডিসি) নাজমুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ডিএমপির সাইবার ইউনিটের সাবেক এই অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের (এডিসি) বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর প্রথম অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা কার্যকরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাজমুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিলেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের মা।
নাজমুলের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরুদ্ধ মত দমনের অভিযোগ রয়েছে। নাজমুল সাইবার ক্রাইমের এডিসি থাকাকালে নাজমুল ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী সরকারের অনলাইন পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষ করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কেউ পোস্ট দিলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা করলে, তাকে ধরে এনে মামলা, নির্যাতন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করতেন। নায়িকা তথা তরুণীরা ছিলেন তার বিশেষ পছন্দের। তাদের ঘিরে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি সাংবাদিকরা সরকারবিরোধী কিংবা নাজমুলের পছন্দের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলে, তাকে তুলে নিয়ে হুমকি-ধমকি দিতেন। গণমাধ্যমে কর্মরত একজন সাংবাদিককে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাজমুল ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছেন, সেই রেকর্ডও রয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালাগালের সেই রেকর্ডটি শুনলে যে কারো গা শিউরে উঠবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে শায়েস্তা করতেও খায়েশ জানিয়েছিলেন নাজমুল। তবে ৫ আগস্টের পর মুখোশ বদলানোর চেষ্টা করছেন। নিজেকে বিএনপিপন্থি পরিচয় দেওয়ার চেষ্টাও করছেন তিনি। অনলাইন মাধ্যমে যারা টাকা আয় করেন, তারা ছিলেন নাজমুলের অন্যতম টার্গেট। ইউটিউব, ফেসবুক এবং ফিল্যান্সিং করে যারা টাকা আয় করেন-তারাও ছাড় পেতেন না। এর মধ্যে ইউটিউবার মতিউর রহমান অন্যতম। ইউটিউবার মতিউরের কাছ থেকেও প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নাজমুল সিন্ডিকেটের কয়েকশ কোটি টাকার বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাজমুল ইসলাম সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার ব্যক্তিগত নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে। যদিও গত ১১ মার্চ তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেছিলেন, পেশাগত জীবনে নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করিনি।
আপনার মতামত লিখুন :