৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনে।
হাসপাতালের ২২ ইউনিট কমিয়ে ১২টি করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটের চিকিৎসকদের কাছে একজন রোগীর বিনা মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্লিপ পান। কিন্তু সম্প্রতি ২২ জনের জায়গায় মাত্র ১০ জন করাতে পারছেন বিনা মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
এতে করে সরকারের রাজস্ব বাড়লেও গরিব রোগীদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালটিতে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন এত রোগী আসছে, যে তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। বহির্বিভাগে এত লম্বা লাইন থাকে যে অনেক রোগী টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে অনেকে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এর জন্য হাসপাতালে সক্ষমতার তুলনায় বেশি রোগী আসাকে দায়ী কবে কর্তৃপক্ষ।
তাদের দাবি, হাসপাতালটিতে বছরে সেবা নেয় অন্তত ৫ লাখ রোগী। কিন্তু এদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ রোগীর। তাই ইচ্ছে থাকলেও যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।
এ ছাড়া জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রয়েছে হার্টের স্ট্যান্ট/রিং ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগও। সরকারনির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে চিকিৎসকেরা কমিশনের ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দের কোম্পানির রিং কেনার জন্য রোগীর স্বজনদের চাপ দেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, বহির্বিভাগে টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা ভিড়। কাচের ওপাশ থেকে টাকা নিয়ে টিকিট দিচ্ছেন হাসপাতালের একজন কর্মী। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন অনেক রোগী। বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালটিতে ডাক্তার দেখাতে নরসংদীর ভেলানগর থেকে এসেছেন ইন্দ্রজিৎ সাহা।
তিনি বলেন, ‘তীব্র ব্যথা নিয়ে এসেছিলাম জরুরি চিকিৎসার আশায়।
সেই সকালে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এখন দুপুর শেষ হতে চলল, তবু লাইন শেষ হয় না। অসুস্থ শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো কত কষ্ট, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আমরা বুড়া মানুষ। দাঁড়াইয়া থাকলে পা ব্যাথা হইয়া যায়। আমাগো লাইগা কোনো ব্যবস্থা যদি করত, তাহলে ভালো হইত। এইভাবে লাইনে দাঁড়ানো কষ্টকর।’
একই রকম ভিড় মেডিসিন বিভাগের সামনেও। চেম্বারে ডাক্তার এখনো আসেননি। অপেক্ষারত রোগীদের মধ্যে গুঞ্জন। ততক্ষণে ডাক্তার আসতেই মৃদু হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। একসময় তা গড়াল চিৎকারে। কারণ এক রোগী অন্য রোগীর আগেই ঢুকে পড়েছেন। পরে একজন আনসার সদস্য এসে ঝামেলা মিটমাট করে দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এমন ভিড় এক্স-রে রুমের সামনে, ইসিজি রুমের সামনে, লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার রুমের সামনেও। রোগীরা একজনের ওপর আরেকজন উঠে যাচ্ছেন কার আগে কে পরীক্ষা করাতে পারবেন এই প্রতিযোগিতা। কম মূল্যে পরীক্ষা করানোর সুবিধা থাকায় সবাই এখানেই পরীক্ষা করাতে চান। কিন্তু অপরিচ্ছন্ন ইসিজি রুমে নেই কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বালাই।
এক রোগী পরীক্ষা করে ওঠামাত্রই আরেক রোগীকে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। একই মেশিন কোনো ধরনের সেনিটাইজ না করেই অন্য রোগীর শরীরে লাগানো হচ্ছে।
ফলে এক রোগীর শরীরে যদি কোনো জীবাণু থেকে থাকে, তা অন্য রোগীর শরীরে চলে যাচ্ছে।
কোনো ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা কেন রাখা হয় না, জানতে চাইলে দায়িত্বরত টেকনোলজিস্ট বলেন, মাথার পেছনে চাইয়া দেখেন কত রোগী। একজনের মাথা আরেকজন ভাঙে এমন অবস্থা।
৮০ টাকায় পরীক্ষা করার জন্য সবাই যেন একসঙ্গে রুমে ঢুকে যাবে। বিছানাটা পরিষ্কার করা হবে কখন? সুযোগ আছে? তার কথার সত্যতা মিলল রোগীদের ধাক্কাধাক্কি দেখে। কার আগে কে লাইনে দাঁড়িয়েছে এই নিয়ে তর্কযুদ্ধ লেগে যাওয়া দুই রোগীর ভাষ্য ওপর থেকে একজন অধ্যাপক তাকে তাড়াতাড়ি ইসিজি পরীক্ষা করে যেতে বলেছেন।
নইলে তিনি চলে যাবেন। আজ আর দেখাতে পারবেন না। তাই তিনি লাইন ভেঙেই ইসিজি রুমে ঢুকতে যাচ্ছেন। আর তাতেই লাইনে দাঁড়ানো অপর রোগীরা বাদ সাধেন।
তাদের ভাষ্য, সে পরে এসে আগে পরীক্ষা করে চলে যাবে, সেটা কীভাবে হবে? তীব্র গরমে যেখানে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
শয্যাসংখ্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেশি হওয়ায় হাসপাতালটিতে লেগে থাকে শয্যার সংকটও। গত সপ্তাহে হঠাৎ করে বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হন সুনামগঞ্জের রুস্তম মিয়া। কিন্তু হাসপাতালে আসার দিন তিন পার হয়ে গেলেও পাননি একটি পেয়িং বেডও (ভাড়া বিছানা)। তাই চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছেন হাসপাতালের বারান্দাতেই।
অন্য কোনো হাসপাতালে যাবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনছি, হার্টের চিকিৎসার লাইগা এই হাসপাতালই সেরা। সেই জন্যই এইখানে আসছি। সুস্থ না হইয়া অন্য কোথাও যামু না।’
তবে রয়েছে সুস্থতার গল্পও। গত মাসে হার্টে ব্লক নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হন বাড্ডার বাসিন্দা নাজমুল হাসান। রিং পরানো শেষে সুস্থ হয়ে মেয়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরছেন তিনি।
বলেন, প্রথম প্রথম সিট না পাওয়া, অপারেশনের তারিখ না পাওয়া নিয়ে খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সুস্থতার জন্য সব ধরনের কষ্ট সহ্য করেছি। অবশেষে চিকিৎসকদের আন্তরিক সেবায় সুস্থ হয়ে আজ বাড়ি যাচ্ছি।
এক মাসের অভিজ্ঞতায় আমি বলব এই হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি। নইলে এত রোগী কোথায় যাবে? হার্টের চিকিৎসার জন্য এই একটি মাত্র হাসপাতালই তো ডেডিকেটেড রয়েছে। যদিও অন্য হাসপাতালগুলোতেও হৃদরোগ বিভাগ রয়েছে। কিন্তু মানুষ হৃদরোগ আক্রান্ত হলেই এখানে আসে। আর এসেই পরে নানান রকম ভোগান্তিতে।
রয়েছে হাসপাতালটিতে হার্টের স্ট্যান্ট/রিং ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগও। সরকারনির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে চিকিৎসকেরা কমিশনের ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দের কোম্পানির রিং কেনার জন্য রোগীর স্বজনদের জোর করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
হাসপাতালটির সিসিউতে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই বছর আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর হার্টেে রিং ভেদে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ায়। গত বছর এলেক্স প্লাস স্টেন্টের দাম ছিল ৫৩ হাজার টাকা, পরে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৬০ হাজার টাকা।
একইভাবে আল্টিমাস্টার টেনসেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা, সেটির দাম বাড়িয়ে করা হয় ৬৬ হাজার টাকা। ৫৫ হাজার টাকার ডিরেক্ট স্টেন্ট সিরোর দামও ৬৬ হাজার টাকা করা হয়। সব আমি অনলাইনে খুঁজে বের করেছি। কিন্তু এখানে আসার পরপরই ডাক্তার যে রিংয়ের কথা বলে, সেটির দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
পরে অনলাইনে দাম বের করে দেখালে আমাকে জানায়, আমাদের পছন্দ অনুযায়ী যেন রিং নিয়ে আসি। পরে রোগীর যদি কোনো সমস্যা হয়, তার দায়ভার তাদের থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে এখানে রোগীর অপারেশন করাব কি না, বুঝতে পারছি না।
তবে সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হাসপাতালটি রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ ওয়াদুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার থেকে আমাদের যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার ভিত্তিতে রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব বছরে ১ লাখ। কিন্তু গত বছর আমরা এখানে সেবা দিয়েছি বহির্বিভাগ, ওয়ার্ড, কেবিন মিলিয়ে ৫ লাখ।
প্রায় পাঁচ গুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে বাজেটের তুলনায়। তাহলে কীভাবে একটি হাসপাতালের পরিবেশ স্বাভাবিক থাকবে বলেন? আমরা প্রয়োজনীয় ক্লিনার পর্যন্ত পাচ্ছি না। হাসপাতালটি পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হচ্ছে না ক্লিনারের অভাবে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বারবার আমাদের সংকটগুলোর কথা জানিয়েছি।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হাসপাতালটির পরিধি বাড়ানো হবে। কিন্তু আমি বরাবরই হাসপাতালের পরিধি বাড়ানোর বিপক্ষে।
আমি মনে করি, হৃদরোগের চিকিৎসার বিকেন্দ্রিকরণ প্রয়োজন। প্রতিটি জেলায় না হোক, বিভাগীয় শহরগুলোতে হলেও হৃদরোগী চিকিৎসার একটি করে হাসপাতাল তৈরি হোক। তাহলে আমাদের ওপর এত চাপ পড়বে না। আমরা তো কোনো রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারি না।
ঢাকা মেডিকেল, পঙ্গু হাসপাতাল আর হৃদরোগ হাসপাতালে কোনো রোগী এলে সাধারণত ফিরিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। তাই আমরা যেন রোগীকে সুচিকিৎসাটা দিতে পারি, সরকারের কাছে তার জন্য যা যা প্রয়োজন তা দেওয়ার দাবি আমাদের বহু দিনের। হাসপাতালটির নানান সীমাবদ্ধতা থাকার কথা স্বীকার করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, যেহেতু হৃদরোগ চিকিৎসায় এটি ডেডিকেটেড হাসপাতাল, তাই এখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চাপ বেশি হয়। যদিও ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য সব হাসপাতালেও এর চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ রোগী এখানেই আসি। তাই আমরা হাসপাতালটির পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে ভাবছি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিদাওয়াও আমরা শুনেছি। সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।