ঢাকা শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

দখলের কারণে মাঠের সংকট

আব্দুল আহাদ, সিলেট
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৫, ২০২৫, ১১:২৮ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আইমান সাদিক। বয়স ৯। ব্যাগে ফুটবল, মনে ইচ্ছা। কিন্তু সমস্যা একটাই মাঠ নেই। সিলেট মহানগরীতে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ খেলার জায়গা ক্রমেই কমে আসছে। একসময় বিকেল হলেই ছোট ছোট পা ছুটে যেত মাঠের দিকে বল নিয়ে, সাইকেল নিয়ে। তখন মহানগরীর অলিগলিতে, স্কুলের পাশে, বাসার সামনে এমন ছোট ছোট খেলার জায়গা ছিল। আজ সেই দৃশ্য শুধুই স্মৃতি। 

একসময় যে মাঠগুলোতে শিশুরা খেলত, আজ তার অনেকটাই দখল হয়ে গেছে নির্মাণাধীন ভবন, বাজার, ক্লাব বা পার্কিং জোনে। আর যেটুকু আছে, তা-ও শিশুদের জন্য নয়, সেখানে চলছে বড়দের খেলা কিংবা ঘুরে বেড়ায় কুকুর অথবা মাঠভর্তি জঞ্জাল।

সিলেট মহানগরীর সুবিদবাজার এলাকার শিশু আইমানের সহজ-সরল কথা, ‘আমি বিকেলে খেলতে যাই, কিন্তু যেখানে খেলি, ওখানে পাথর, ধুলা আর অনেক সময় বড়রা তাড়িয়ে দেয়।’

তার মা তাহমিনা বিনতে রুজি বলেন, ‘সাবেক মেয়র সাহেব মাঠ তৈরি করবেন শুনেছিলাম, কিন্তু মাঠ তো দূরের কথা, যেটুকু ছিল তা-ও ঘেরা হয়ে গেছে। শিশুরা ঘরে বন্দি, খেলছে মোবাইল ফোনে। এতে শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। খেলাধুলা ছাড়া শিশুদের মনে বিকাশ ঘটে না। শিশুর হাসির জন্য মাঠ ফেরত চাই। সুন্দর আগামীর জন্য শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমরা খেলাধুলার জন্য কয়েকটি নতুন মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিকল্পনা করছি। তবে জায়গার সংকট ও দখলদারদের কারণে তা বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করব আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিকল্পনা ব্যস্তবায়ন করার।’

সিলেট মহানগরীতে শিশুদের খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ জায়গার সংকট দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। বিশাল দালান, শপিংমল, পার্কিং স্পেসের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। শুধু ধুলোবালি নয়, এখন শিশুরা শ্বাস নেয় ইট, বালি আর যন্ত্রচালিত শহরের কংক্রিটে।

মহানগরীর বুকে শিশুরা কোথায় যাবে খেলতে? আম্বরখানা এলাকার বাসিন্দা ও ছয় বছরের সন্তানের মা মাহমুদা হক বলেন, ‘আমার ছেলে বিকেলে খেলতে চায়, কিন্তু কোথায় নেব? রাস্তায় গাড়ি, পার্কে বড়রা হাঁটে আর মাঠগুলো প্রাইভেট ক্লাবে পরিণত হয়েছে।’

সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার একমাত্র বড় মাঠ এমসি কলেজ মাঠ ও আলীয়া মাদ্রাসা মাঠ প্রায় সব সময় বড়দের ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ বা বিভিন্ন প্রোগ্রামের দখলে থাকে। শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় বরাদ্দ নেই। এমসি কলেজ মাঠে শিশুদের খেলাধুলা করার মতো অবস্থা নেই। মাঠজুড়ে রয়েছে উঁচু-নিচু গর্ত আর এলোমেলো পাথর-মাটি। তার পরও মাঠের কিছু অংশে নিয়ম করে সকাল-বিকাল ফুটবল ক্লাবের অনুশীলন করে অনেকেই, কিন্তু শিশুরা থাকে উপেক্ষিত।

নগরীর পাঠানটুলা, সুবিদবাজার, আম্বরখানা, কাজীরবাজার এলাকাগুলোতে খেলাধুলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ বা উন্মুক্ত জায়গা নেই বললেই চলে। অনেক শিশু এখন পড়ালেখার বাইরে সময় কাটায় মোবাইল ফোনে বা ট্যাবের গেম নিয়ে।
এ বিষয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেজওয়ানা হাবীব বলেন, শিশুদের শুধু পড়াশোনা নয়; খেলা, দৌড়ঝাঁপ, সামাজিক মেলামেশা সব মিলেই তাদের বিকাশ।

খেলার মাঠ না থাকা মানে শিশুকে একঘরে করে ফেলা। শিশুরা যখন খেলা থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মধ্যে শারীরিক অস্থিরতা, বিষণ্নতা ও একাকিত্ব তৈরি হয়। শুধু লেখাপড়া নয়, মাঠে গড়াগড়ি খাওয়াও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য দরকার।
বর্তমানে মহানগরীর অধিকাংশ শিশুই ঘরে বসে থাকে মোবাইল ফোন, ট্যাব বা ভিডিও গেমে ব্যস্ত হয়ে। এতে যেমন স্থূলতা, চোখের সমস্যা বাড়ছে, তেমনি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানসিক চাপও বাড়ছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একটি খেলার মাঠ থাকা উচিত। পরিকল্পনায় সেটা রাখা হলেও বাস্তবে তা রক্ষা করা হয়নি। উলটো বহু জায়গা দখল হয়ে গেছে হাউজিং প্রকল্পে। সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পার্ক ও মাঠ উন্নয়নের কথা বলা হলেও মাঠের সংখ্যা তেমন বাড়ছে না, বরং শিশুদের প্রবেশাধিকার কমে যাচ্ছে। আমরা কয়েকটি নতুন পার্ক ও উন্মুক্ত জায়গার পরিকল্পনা করছি। তবে জায়গার সংকট ও দখলদারদের কারণে তা বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে।’

সমাধানে কী করা দরকার? এমন প্রশ্নে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, শিশুবান্ধব নগর পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক করা; প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একটি উন্মুক্ত খেলার মাঠ সংরক্ষণ; স্কুলগুলোকে বিকেল বেলা স্থানীয় শিশুদের জন্য মাঠ উন্মুক্ত করতে উৎসাহিত করা; মাঠ দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ; শিশুদের জন্য আলাদা সময় ও নিরাপত্তাসহ পার্ক উন্নয়নে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো সর্বোপরি শিশুর খেলার জায়গা তার মৌলিক অধিকার।

তিনি বলেন, একটা শহরের আসল প্রাণ থাকে তার শিশুদের হাসিতে, আর সেই হাসি বিকশিত হয় খোলা মাঠে, খেলার উল্লাসে। আজ যদি শহরের শিশুরা খেলতে না পারে, আগামীকাল তারা কীভাবে হাসবে?