বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশে উচ্চারিত হতে থাকে চাই সংস্কার। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন খাতে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন মিলে বাংলাদেশে সংস্কার বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরেই নানা মিশন ভিশন নিয়ে গঠিত হয়েছে নতুন অনেক রাজনৈতিক দল। সরকারের পতনের পর গত আট মাসে ২৬টি রাজনৈতিক দলের উত্থান হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার বহিঃপ্রকাশ। তবে দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। অনেকে মনে করছেন, এই ছোট নতুন দলগুলো মিলেই গঠিত হবে ‘স্যার রক্ষা দল’। নব্য দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের জয়গান গাইবে, নাকি চাহিদাসম্পন্ন গণ-ইস্যুগুলো তুলে আনবে, তা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দলগুলো জনপ্রত্যাশিত কণ্ঠের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কতটা এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া দলগুলোর চর্চার ক্ষেত্র ও পরিবেশ কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে বিশ্লেষকদের ভিন্ন রকমের ভাবনা।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা প্রায় সাত মাস পর গঠন করে রাজনৈতিক দল এনসিপি। শিক্ষার্থীদের দল ছাড়াও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্ত হয়েছে নিউক্লিয়াস পার্টি, জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা পার্টি।
একইভাবে আট মাসে অন্তত ২৬টি নাম যুক্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’ নামে নতুন আরও একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দল গঠনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন নতুন নতুন দল গঠন করতে দেখা গেছে। আর নির্বাচনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। বিশ্লেষকদের চোখে নির্বাচনের সময় ‘ব্যাঙের ছাতার মতো দল গজিয়ে ওঠে’। তবে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশকে আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত করা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই তা স্বার্থ ও ক্ষমতাচর্চার একটি রূপ বলেই মত বিশ্লেষকদের।
‘দেশে বিভিন্ন সময়ে নানা পেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে’ বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেশি রাজনৈতিক দল হওয়া অন্যায় কিছু নয়। মূল বিষয়, দলগুলো জনগণ গ্রহণ করছে, নাকি বর্জন করছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ পাবে সঠিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। যত দ্রুত নির্বাচন শুরু হবে, তত দ্রুত তাদের পরীক্ষা শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সততা, নিরপেক্ষতা এবং তাদের কাজের দক্ষতার ওপরও নতুন দলগুলোর ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে। তবে, নতুন দলগুলো যদি অন্য দলকে সুবিধা দিতে তথাকথিত পার্টি হয়, তাহলে সেই দল বাংলাদেশের মানুষের কোনো কাজে আসবে না, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করবে, অচল করে দেবে। নাগরিকের অধিকার খর্ব করবে।’
নতুন রাজনৈতিক দল প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘দল গঠনের যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে, বর্তমানে নতুন রাজনৈতিক যে দলগুলো গঠিত হচ্ছে, সেখানে সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হঠাৎ করে নির্বাচন সামনে রেখে ছোট ছোট দল গঠন হচ্ছে। যারা দল গঠন করছেন, তাদের অনেকেই বিতর্কিত।’
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘৯০ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে ও নানা সুবিধা নিতে নতুন দল গঠন হয়। তবে নতুন দল গঠন নিয়ে যে গুঞ্জন তা সঠিক নয়। স্যার (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) রক্ষা নয়, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে ব্যক্তিস্বার্থে গঠিত হচ্ছে এসব রাজনৈতিক দল। আর ড. ইউনূস সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আছেন। সুতরাং তার জন্য এভাবে বৈধ্যতার প্রয়োজন নেই। বর্তমানে জনগণ অনেক সচেতন; সে ক্ষেত্রে নতুন দলের লোকরা হালে পানি পাবেন বলে মনে হয় না।’
নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানায় বিএনপি। গণতন্ত্রের মাঠে শত ফুল ফুটবে; তাদের স্বাগত জানাব আমরা।’
মাসে গড়ে তিনটি নতুন দল
২০২৪-এর অগাস্ট থেকে ২০২৫-এর ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত গত আট মাসে অন্তত ২২টি রাজনৈতিক দল ও চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এর মধ্যে গত বছর ১১টি আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আরও ১১টি দল গঠিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হয়েছে।
আত্মপ্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে আছে নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) ও জনতা পার্টি বাংলাদেশ।
রাজনীতিতে আসা নতুন দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনায় রয়েছে এনসিপি। দলটি এখনো নিবন্ধন পায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নামক যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে দলটি তৈরি হয়েছে, সেগুলোও বর্তমানে সচল আছে।
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এনসিপির গঠন থেকে বেরিয়ে আসা শিবিরের সাবেক নেতাদের নতুন সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’এর চলতি মাসের মধ্যেই আত্মপ্রকাশের কথা রয়েছে।
নতুন দল নিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে, তা নিয়ে কথা হয় রাজধানীর কাকলীর রিকশাচালক আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যাদের চিনি না, তারাও এখন নেতা! প্রধানমন্ত্রী হবার চায়। বউ-বর মিলে দল করে। ১০ জনেও দল বানায় ফেলা যায়। প্রতিদিন নতুন দলের খবর, ভালোই আনন্দ লাগে। সকলে কয় আমাদের ব্যাটারি রিকশা বাড়ছে, আমি দেখি ব্যাটারির সঙ্গে রাজনৈতিক দলও বাড়ছে। ভাবছি, ব্যাটারি যারা চালাই, তারা মিলে একটা দল বানায় ফেলব।’
নতুন দলের বিষয়ে ফুসকা বিক্রেতা আলম হোসেন বলেন, ‘যখন তখন মিছিল-অবরোধ দেখি। এর বাইরে নতুন দল কি আসছে, তার খবর রাখি না। এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর দশকে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। এসব ঘটনার পর রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাক্সক্ষা থেকে বিকশিত হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের মার্চে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরশাদ নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করেন এবং আহসানউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘জনদল’ গঠন করেন। পরবর্তীতে এরশাদের উদ্যোগে ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়।
বিএনপির কিছু নেতা, জনদলের একটি অংশ, মুসলিম লীগ, গণতন্ত্রী দল ও ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সদস্যরা এই ফ্রন্টে যোগ দেন। অবশেষে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে ‘জাতীয় পার্টি’ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে, যার চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
’৯০-পরবর্তী রাজনীতি: জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে একটি ইসলামিক ঐক্য জোট।
ইসলামিক ঐক্য জোট: ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামিক ঐক্য জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই জোটে ছিল সাতটি দল। সেগুলো হলো ১. খেলাফত মজলিস ২. নেজামে ইসলাম ৩. ফরায়েজী জামাত ৪. ইসলামী মোর্চা ৫. উলামা কমিটি ৬. ন্যাপ (ভাসানী) দলের একাংশ ৭. ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। জোটের প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করা, যা খেলাফতের আদলে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
আপনার মতামত লিখুন :