রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ১১:১২ পিএম

শিশু হাসপাতাল

শয্যার তুলনায় ভর্তি ৪ গুণ বেশি রোগী 

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ১১:১২ পিএম

শয্যার তুলনায় ভর্তি ৪ গুণ বেশি রোগী 

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বৈশাখের প্রচণ্ড গরমে ঘেমে একাকার। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশু হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছেন সুলতানা আক্তার। কোলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একমাত্র সন্তান। ভর্তি করাতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, অন্য কোনো শিশু সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে অথবা কোনো শিশু মারা গেলে ফাঁকা হবে সিট। তারপর ভর্তি করানো যাবে। তবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ ভর্তির জন্য সকাল থেকেই অপেক্ষা করছেন শয্যার তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি রোগী।

কাকে রেখে কাকে ভর্তি করা হবে জানেন না শিশু হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসকরাও। তারা বলছেন, প্রতিদিনই শয্যার তুলনায় রোগী আসে প্রায় ৪ গুণ। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তুলনায় নতুন রোগী এত বেশি আসে যে ভর্তি না করাতে পেরে অসহায় অনুভব করেন তারাও। আইসিইউ এবং এনআইসিইউতে কোনো ফাঁকা সিট নেই। লম্বা সিরিয়ালের কারণে আগামী এক সপ্তাহেও সিট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে গুরুত্বর রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। যেখানে আইসিইউর সুবিধা আছে। হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন যাবত শয্যা বাড়ানোর কথা বলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমান কাঠামোতে একটি সিটও বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ জন্য বাড়াতে হবে অবকাঠামোগত সুবিধা। 

রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতাল প্রাঙ্গণের এক কোণায় জমে আছে ময়লার স্তূপ। সুন্দর করে চারপাশ বাঁধানো থাকলেও ময়লার পরিমাণ এত বেশি যে, উপচে পড়ছে আশপাশে। কাক দলবেঁধে ময়লা খাচ্ছে। ঠোঁটে করে ময়লা নিয়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। যেগুলোর সবই মেডিকেল বর্জ্য। যার থেকে মারাত্মক রোগের জীবাণু ছড়াছে। জরুরি বিভাগের অবস্থা আরও খারাপ। শিশু রোগী ও স্বজনদের তীব্র ভিড়ে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। বসার মতো কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই। মেঝেতে বসে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকি দেয়ালের কার্নিশের ফাঁকা জায়গায় বসেও অপেক্ষা করছেন সন্তানের একটু সুচিকিৎসার আশায়। অনেক শিশুর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলেও সিট না থাকায় ভর্তি করানো যাচ্ছে না। দিশাহারা অবস্থায় এক রুম থেকে আরেক রুমে ঘুরছেন তাদের স্বজনরা। রাজধানীর বাড্ডা থেকে এসেছে জ্বরে আক্রান্ত শিশু ইয়াসিন। ৪ দিন ধরে জ্বর। তাকে নিয়ে এসেছেন রোকসানা আক্তার ও তার স্বামী সজিব হোসেন। সকালে যখন এসে বহির্বিভাগে দেখিয়েছেন তখন ডাক্তার ভর্তি করানোর কথা বলেন। কিন্তু সিট ফাঁকা না থাকায় ভর্তি করাতে পারেননি। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। অন্য কোনো রোগী ছাড়পত্র পেলে তাকে ভর্তি করানো যাবে। এই আশায় অসহায় অবস্থায় বহির্বিভাগের সামনে বসে আছেন তারা। তারা বলেন, সন্তান যখন অসুস্থ হয় তখন কোনো মা-বাবারই মাথা ঠিক থাকে না। কাল রাতে জ্বর বাড়ায় আজ ভোর বেলায় নিয়ে এসেছি। জ্বর এখনো ১০২ এর উপরে। ডাক্তার ভর্তি দিলেও সিটের অভাবে ভর্তি করাতে পারছি না। শিশুদের জন্য এই হাসপাতালের মতো সেবা তো অন্য হাসপাতালে পাওয়া যাবে না। তাই অপেক্ষায় আছি কখন একটি সিট ফাঁকা হবে। 

ততক্ষণে মধ্য আকাশের সূর্য পশ্চিমের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। তখনো টঙ্গি থেকে আসা শিপ্রা সরকার শিশুসন্তানটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন হাসপাতালের বারান্দায়। কেউ একজন বলেছেন, ৪টার দিকে একটা বেড খালি হতে পারে। তখন ওই বেডে ভর্তি করানো যাবে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু সুশান্তকে। বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অক্সিজেন মাস্ক ছেলের মুখে দিয়ে গুণছেন অপেক্ষার প্রহর। আদৌ তার এ অপেক্ষার ফল ইতিবাচক হবে কি না জানেন না। বিকেল ৪টার পরে কীভাবে হাসপাতালে বেড খালি হবে খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেল আরেক নির্মম কাহিনি। রাজধানীর শনির আখড়া থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া এক শিশুকে গত তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করেন বাবা। প্লাটিলেট নেমে গিয়ে ৫০ হাজারে চলে আসছে।  কর্তব্যরত ডাক্তার বলেছেন, এনআইসিইউতে (নিউনেটাল ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) স্থানান্তর করতে। কিন্তু  খালি নেই এনআইসিইউর বিছানা। আশপাশের কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে দিকভ্রান্তের মতো একটি এনআইসিইউ খুঁজলেও গত দুই দিনে পাননি। আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে, বেসরকারি হাসপাতালেও শিশুকে ভর্তি করাতে পারবেন না।
 
এদিকে চোখের সামনে শিশুটির জীবনপ্রদীপ একটু একটু করে নিভছে। এক ওয়ার্ডবয় কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে শুনেছেন যেকোনো সময় দুঃসংবাদ আসতে পারে। আর তাহলে এই শয্যাটি খালি হবে। ওই ওয়ার্ড বয়ের কাছে টঙ্গি থেকে আসা শিপ্রা সরকার আশ্বস্ত হয়েছে শয্যাটি নিজের সন্তানের জন্য পাবেন। আর তাই গুণছেন অপেক্ষার প্রহর। শুধু শিপ্র সরকার বা রোকসানা আক্তার নয়, চিকিৎসকের রাউন্ড শেষেও কয়েকশ অভিভাবককে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা যায় প্রতিদিন। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, খোদ হাসপাতালটির পরিচালকের কিছু করার নেই বলে দাবি করা হয়। রূপালী বাংলাদেশকে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক বলেন, ৬৮০টি শয্যার সব শয্যায় শিশু রোগীতে পরিপূর্ণ। আইসিইউ, এনআইসিইউ, এইচডিওসহ আরও প্রায় ৯০টি শয্যারও কোনোটি খালি থাকে না। সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় এ সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এমন অবস্থায় আমার নিজের পরিবারের কারও যদি কোনো সিটের প্রয়োজন পরে তাহলেও কিছু করতে পারব না। এক্ষেত্রে সত্যি অসহায় আমরা। মাত্র ৬৮০টি শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন রোগী আসে ৪ থেকে ৬ হাজার। এত রোগী আমরা কোথায় ভর্তি করাব? বয়স্ক রোগীদের বেলায় সরকারি হাসপাতালে মাটিতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। একটি শয্যা মানে একটি শিশু।
 
এক্ষেত্রে শয্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে বর্তমান অবকাঠামোতে শয্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ ব্লক বা সি ব্লক কোনো ব্লকেই আর একটিও শয্যা বাড়ানো যাবে না। তবে ভবনটি ৯ তলা করার পরিকল্পনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছু হলেও হতে পারে। হাসপাতালের সামনে ময়লার ভাগাড় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি নিয়মিত পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু পরিচ্ছন্ন কর্মীরা অনেক সময় ফাঁকি দেয়। এগুলো থেকে অনেক রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। যা কারোই কাম্য নয়। আমরা রোগীদের সেবা দিতে চাই। প্রতিটি মানুষের সুস্থতা চাই। এই ব্রত নিয়েই কাজ করছি। 

১৯৭৭ সালে শের-ই-বাংলা নগরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশের জনসংখ্যা এবং বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বিচ্ছিন্ন ও সীমিতভাবে দরিদ্র রোগাক্রান্ত শিশুদের জন্য চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে শিশুদের সার্বিক চিকিৎসার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটি কোনো আইনগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল অধ্যাদেশ ২০০৮’ গেজেট আকারে প্রকাশ করে। নবম জাতীয় সংসদের বিশেষ কমিটির সুপারিশে জারি করা ১২২টি অধ্যাদেশের মধ্যে ৫৪টি অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়। অননুমোদিত ৬৮টি অধ্যাদেশের মধ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতাল অধ্যাদেশ ছিল একটি। ঢাকা শিশু হাসপাতালের কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে একটি আইন করা হয়।  

ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে একীভূত করে ২১টি ধারা সম্বলিত ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট আইন, ২০২০’ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয় ওই সময়। আইন অনুযায়ী ইনস্টিটিউটের সুষ্ঠু পরিচালনা ও প্রশাসন সার্বিকভাবে একটি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং এ লক্ষ্যে সরকার একজন চেয়ারম্যানসহ ১২ সদস্যের ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করবে। বোর্ডের চেয়ারম্যান ও মনোনীত সদস্যরা তাদের মনোনয়নের তারিখ থেকে তিন বছরের মেয়াদে নিজ পদে বহাল থাকবেন। পরে গত বছরের ২৮ জুন বিলটি সংসদে উত্থাপন হয়। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। এর পর বিলটি পাসের জন্য সংসদে উপস্থাপিত হয়। বিলটি পাস হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে ইনস্টিটিউশনাল কার্যক্রম শুরু করা যায়নি বলেও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখনো সেই আগের নিয়মেই এগিয়ে চলছে চিকিৎসাসহ অন্যান্য সব কার্যক্রম। ফলে রোগীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

Link copied!