ঢাকা রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

বাড়ছে জোট-মহাজোটের সমীকরণ

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ১১:২৮ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যে রাজনীতির মাঠে শুরু হয়েছে ভোটের আমেজ। প্রতি মাসেই আত্মপ্রকাশ করছে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল। আবার জোটবদ্ধ না এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন সেই হিসাবও কষতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। বিএনপি, জামায়াত, সিপিবি-বাসদ, ইসলামী আন্দোলন-খেলাফত মজলিস, এনসিপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের বলয় ভারি করতে ছুটছেন ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের দুয়ারে। দলগুলোর শীর্ষ নেতারা একের পর এক সিরিজ বৈঠক করছেন বিভিন্ন দলের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি জোট হওয়ার আলোচনা চূড়ান্তের পথে। তবে ভোটের রোডম্যাপ চূড়ান্ত হলেই সব সমীকরণ মিলিয়ে এসব জোট আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের সময় রাজনৈতিক জোট হওয়া নতুন কিছু নয়। প্রতিবারই বিভিন্ন দল সমমনা দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করে। আগামী নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে জোট-মহাজোটের হিসাব পুরোপুরি পরিষ্কার হবে। 

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্যমতে, দেশের বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৫। অনিবন্ধিত দলের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে ৬৬টি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য ইতোমধ্যে ইসিতে আবেদন করেছে। এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদনের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ইসিতে আবেদন করেছে।

এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে এখনো অনঢ় বিএনপি। তাদের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছে ডান-বামসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। আবার এনসিপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন না দিয়ে আগে সংস্কারকাজ শেষ করার জন্য। সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবিতে তারাও অনঢ়। ভোট নিয়ে কৌশলী জামায়াতে ইসলাম। তারা একদিকে যেমন ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলছে না আবার সংস্কার শেষেও নির্বাচনের কথা বলছে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে অন্য উপদেষ্টাদের মুখেও এমনই কথা উঠে আসছে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। সরকার ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান শক্তি তাদের বাইরে রেখেই নির্বাচন করতে চায়। বড় এই রাজনৈতিক শক্তি মাঠে না থাকলেও মসৃণ হয়নি ভোটের রাজনীতি। বিএনপিসহ অন্য বড় দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পাশে টানছে ছোট দলগুলোকে। ভোটের মাঠে কদর পাওয়া ছোট দলগুলো কার সঙ্গে জোট করবে তা নিয়ে শেষ সময়ে হিসাব কষতে শুরু করেছে। এই সুযোগে তারা আসন নিয়েও দরকষাকষি করে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ভোটের রাজনীতিতে জোটের মেরুকরণ এখন অনেকটা স্পষ্ট।
 
রাজপথের শক্তিশালী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে একসময় ছিল শক্তিশালী জোট। তবে তাদের সম্পর্ক এখন আর আগের মতো মধুর নয়। দুই দলের বিরোধ অনেকটা স্পষ্ট হওয়ায় সামনে এই দুই দল মিলে জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে বিএনপি আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে না অন্য ফর্মুলায় নির্বাচন করবে তা এখনো পরিষ্কার না করলেও পাশে চাচ্ছে ছোট ছোট দলগুলোকে। 

চলতি বছরের শুরুতে বিএনপি খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। খেলাফত মসলিসের পর আরেকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করলেও এরপর সেই প্রক্রিয়া আর গতি পায়নি। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে আবারও ছোট দলগুলোকে পাশে টানতে সম্প্রতি তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ডান-বাম বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সবাইকে নিয়ে ভোটের জন্য জোরালো আন্দোলনের চিন্তা তাদের।

বিএনপির এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রক্রিয়ায় রয়েছে অতীতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো। এর বাইরেও বিভিন্ন দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি। তবে আপাতত বিএনপি নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করার চিন্তা করছে। সেই কারণে জোট করার প্রয়োজন হবে কি নাÑ তা নিয়েও আলোচনা করছে দলটি। 
 
বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেন, আপাতত জোট গঠনের থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট আদায়ের দিকে বিএনপি বেশি মনোযোগী। তবে ভোটের সময় আসলে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জোট করা হতে পারে। এই জোটে অগ্রাধিকার পাবে অতীতে এবং বর্তমানে যেসব দল পাশে ছিল তারা।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, যারা ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করেছে তাদের জোটে রাখা হবে না।  দেশের মানুষ যাদের পছন্দ করে না তাদের সঙ্গে বিএনপিও থাকেবে না।  তবে যারা বিগত সময় আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির সঙ্গে ছিল তাদের নিয়েই জোট হবে। 

বিএনপির সঙ্গে জোটের আপাতত কোনো সম্ভাবনা থাকলেও ইসলামী দলগুলো নিয়ে নির্বাচনি জোট করতে চায় জামায়াতে ইসলামী। ইতোমধ্যেই তারা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন দল কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। ইসলামী দলের পাশাপাশি আরও কিছু রাজনৈতিক দলকেও পাশে চায় তারা। 

জোট প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জোট গঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এখনো ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারও বসব। এই জোট চূড়ান্ত রূপ নেবে যখন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হবে। 

দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, জোট হয় মূলত দুই ধরনের। একটা হয় আন্দোলনের, আরেকটা হয় নির্বাচনের। আমরা নির্বাচনি জোট করতে চাই। ইসলামী দলগুলো সবাই এটা বলছে যে, জাতীয় নির্বাচনে আমরা বিভিন্ন আসনে ইসলামী দলগুলো থেকে একক প্রার্থী রাখব। ইসলামী দলগুলোর একাধিক প্রার্থী যেন না থাকে। এই আলোচনাই চলছে। সুতরাং এই জোট যখন হবে, সেটা নির্বাচনকেন্দ্রিক হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা গঠন করেছেন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। তারুণ্যের এই দলটি বিএনপি নাকি জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে, নাকি এর বাইরে নতুন চমক নিয়ে আসবে তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল রয়েছে। 

বিএনপি-জামায়াতের মতো নিজস্ব বলয় তৈরিয়ে পিছিয়ে নেই এনসিপিও। তারাও ইতোমধ্যে খেলাফত-মজলিসসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়াও দল গোছানের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে দলটি।

এনসিপির একাধিক নেতা জানান, নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি। যখন নির্বাচন হবে তখন দেখা যাবে কে কোন জোটে যায়। সে সময় যে কারো সঙ্গেই জোট হতে পারে।

দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এনসিপি নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক জোটের কথা ভাবছে না। এনসিপির এখনকার অ্যাজেন্ডা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন। এই বিষয়গুলো আমরা সামনে আনতে চাই, জনগণের কাছে যেতে চাই। আমাদের দল এবং বক্তব্যকে জনগণের কাছে পরিচিতি করানোই এখন মুখ্য।

অন্যদিকে যুক্তফ্রন্টের আদলে নতুন বামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা চলছে সিপিবি-বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ। আগামী নির্বাচনে সব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারা। জোট গঠনের মূল উদ্যোক্তা বাম গণতান্ত্রিক জোট। শিগগিরই বাম গণতান্ত্রিক জোটের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।    

সূত্র জানায়, বাম গণতান্ত্রিক জোট নেতারা এরই মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরাম, জাতীয় গণফ্রন্ট, ঐক্য ন্যাপসহ কয়েকটি প্রগতিশীল দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, দলিত ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একাধিক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গণসংগঠনের সঙ্গেও তাদের আলোচনা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে বিকল্প একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে সব দল ও জোটের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। বৃহত্তর জোটের ব্যানারে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেষ্টাও রয়েছে বাম প্রগতিশীল দল ও শক্তিগুলোর মধ্যে।

এ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামকে বাইরে রেখে আলাদা জোট করতে চায় ইসলামপন্থি কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সর্বশেষ গত বুধবার এসব দলেল নেতারা বৈঠক করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিস নেতারা এ বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক শেষে জানানো হয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ ধরনের আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং ধাপে ধাপে অন্য ইসলামী দলগুলোকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওই বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আপাতত জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখেই তারা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কাটিয়ে কাছাকাছি আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থিদের আসনভিত্তিক একক প্রার্থী দেওয়ার যে আলোচনা চলমান রয়েছে, এই আলোচনায় জামায়াত নেই।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। এগুলো বাস্তবায়নে আমরা সামনে কাজ করব। সামনে আরও আলোচনা হবে, বসা হবে। 

এর বাইরে ভোটের সময়ক্ষণ ঘনিয়ে আসলে ছোট ছোট দল মিলে আরও কয়েকটি জোট গঠন হতে পারে বলেও জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, অতীতে দেখেছি ভোটের সময় অনেক জোট হতে।

বিএনপি সমমনা ১২ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিও (কাজী জাফর), এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ ভোটের মাঠে জোট রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম বলেন, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক জোট নতুন কিছু নয়। দল থাকবে জোট থাকবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে, নতুন নতুন জোট হয়ে বিশেষ কোনো দলকে বা ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার জন্য হলে দেশের বা জনগণের কোনো উপকারে আসবে না। তবে সুনির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে দল গঠন ও জোট ক্ষতির কারণ হতে পারে।