সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ০১:১২ এএম

শেষ আশ্রয় ঢাকা মেডিকেল নেই তিল ধারণের ঠাঁই

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ০১:১২ এএম

শেষ আশ্রয় ঢাকা মেডিকেল নেই তিল ধারণের ঠাঁই

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

শনিবার বেলা ২টা। ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের বিপরীত পাশে মোটরসাইকেল রাখার ছাউনির নিচে বিছানা পেতে, পাটি পেতে শুয়ে আছেন ৫০ বছর বয়সি ইসমাইল হোসেন। পাশেই স্ত্রী বাদামি বেগম হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। দেখে শুয়ে আছেন মনে হলেও কাছে গিয়ে ভুল ভাঙে। তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি। আর স্ত্রী সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ‘আর একটু ধৈর্য ধরো। একটা না একটা সিট পাওয়াই যাবে।’  কী হয়েছে জানতে চাইলে বাদামি বেগম বলেন, ‘কোমরে একটু ঘা হয়েছিল। প্রথম দিকে অতটা পাত্তা দেওয়া হয়নি। আর সেইটাই কাল হয়েছে। এখন পচন ধরেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতদিয়া থেকে এসেছি এখানে। ওখানকার ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি নেয়নি। বলেছে এখানে নিয়ে আসতে। গতকাল রাতে এসেছি। কিন্তু সিট খালি না পাওয়ায় অপেক্ষা করছি সেই থেকে। আমার ছেলেটা গেছে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে। আল্লাহ জানেন কখন ভর্তি করাইতে পারব।’

সারা দেশের সব হাসপাতালই যখন রোগী ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন শেষ আশ্রয় দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বিশাল হাসপাতালটিতে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসে হাজার হাজার রোগী। ভর্তির প্রয়োজন পড়লে কাউকেই ফেরানো হয় না। কিছু কিছু ওয়ার্ডে একেক শয্যা বরাদ্দ দেওয়া হয় একাধিক রোগীকেও। তবুও কাউকে ফেরানো হয় না বিনা চিকিৎসায়। কিন্তু মাঝে মাঝে রোগীর সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে চিকিৎসকদেরও করার কিছু থাকে না। রোগীর তুলনায় হাসপাতালের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে খোদ কর্তৃপক্ষও। বিগত সরকারের সময় হাসপাতালটিকে বড় করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ ব্যাপারে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা। জনগণের স্বার্থে হাসপাতালটির পরিধি বাড়ানোর তাগিদ সব মহলের।

সরেজমিনে দেখা যায়, অধিক রোগীর কারণে একই শয্যা একাধিক রোগীর নামে বরাদ্দ থাকায় বাকি রোগীদের চিকিৎসা নিতে হয় মেঝেতে থেকে। একইভাবে রোগী বহনের ট্রলি, হুইলচেয়ারের স্বল্পতায় কোলে করেও স্বজনদের নিয়ে যেতে হয় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। এর ওপর রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সচালকদের দৌরাত্ম্য। সুস্থ হোক বা মারা যাক, রোগী বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে হলে স্বজনদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়েও। যন্ত্রপাতির তুলনায় রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হওয়া দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন রোগীরা। 

পেটের তীব্র ব্যথায় ভোগা বাবাকে নিয়ে রাজশাহীর বাঘা থেকে এখানে চিকিৎসা করাতে এসেছেন আলমগীর হোসেন। ঢাকায় একটি বেসরকারি অফিসে চাকরি করলেও বাবা-মা গ্রামে থাকেন। বাবা অসুস্থ থাকার কথা শুনে বাড়ি গিয়ে দেখেন অবস্থা খারাপ। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু দ্রুততম সময়ের মধ্যে এলে কী হবে, হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোলিভার বিভাগে সিট খালি না থাকায় ভর্তি করাতে পারছেন না। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মহাখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। কিছুটা অসহায়ের মতো বললেন, শুনেছি এখানে এলে সবাই সুচিকিৎসা পায়। কিন্তু এত রোগী থাকলে কারো সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ কীভাবে থাকে বলেন? ডাক্তাররাও তো এখানে অসহায়। 

নোয়াখালীর চরজব্বার খাসেরহাট থেকে লিভারের জটিলতায় আক্রান্ত বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে এসেছেন সৌরভ সরকার। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আলট্রাসনোগ্রামসহ দুইটা পরীক্ষা করাতে দিয়েছেন। তারপরই ভর্তি নেবেন বলে জানালে সেই সকাল ৯টা থেকে লাইনে দাঁড়ালেও দুপুর আড়াইটা থেকে চললেও সিরিয়াল পাননি তিনি। কখন সিরিয়াল পাবেন আর কখন বাবাকে ভর্তি করাতে পারবেন এ নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ। একটু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অসুস্থ বাবাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু লাভ কী হলো? সেই ভোরবেলা এলেও এখনো ভর্তি করাতে পারিনি। টেস্ট দুইটা হয়নি বলে। এত লম্বা লাইন কখন গিয়ে শেষ হবে কে জানে? শুধু আল্ট্রাসনোগ্রাম নয়, একই রকমভাবে রোগীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে রোগ নির্ণয়ে এমআরআই, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, ব্লাড টেস্টসহ প্রায় সবগুলো পরীক্ষার রুমের সামনেই। বেশির ভাগ রোগীর অভিযোগ ফি জমা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো আগে ঢুকে সেবা নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন অনেকে। 

রঞ্জন সরকার নামের এক রোগী বলেন, বাইরে এমআরআই পরীক্ষা করাতে অনেক খরচ। তাই এখানে এসেছি খুব ভোর বেলায়। আগেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে বলে। কিন্তু এত সময় দাঁড়াতে হবে তা ভাবিনি। আমার আগে অনেকেই কীভাবে কীভাবে যেন ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরেও যে খুব বেশি পরীক্ষা করা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। দায়িত্বরত এক কর্মী জানান, এমআরআইয়ের জন্য দীর্ঘ লাইন থাকলেও দিনে তিন থেকে চারটার বেশি করা যায় না। ফলে কাউকে সপ্তাহ বা কাউকে এক মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। মেশিন যদি বাড়তি থাকত, তাহলে একসঙ্গে বেশি রোগীর পরীক্ষা করা যেত। 

প্রায় চারটি হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেলে ভালো চিকিৎসার আশায় বাবাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে উন্নত চিকিৎসার আশায় এসেছেন হবিগঞ্জের আজমীরীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সুমন মিয়া। তিনি বলেন, বাইক এক্সিডেন্টে বাবা কোমরে আঘাত পেয়েছিলেন। প্রথমে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে যাই। কিন্তু তারা ভর্তি নেয়নি। ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওখানেও সিট না থাকায় ভর্তি নেয়নি। আসি বারডেমে। কিন্তু ওখানেও খরচ কম না। তাই কম খরচে উন্নত চিকিৎসা করাতে এখানে এসেছি। জরুরি বিভাগে ডাক্তার দেখেছেন। এমআরআই করাতে বলেছেন। কিন্তু এ কয়দিন সিরিয়াল পাইনি। আজ পেয়েছি। কিন্তু এখনো ভেতরে ঢুকতে পারিনি। 

রেডিওলোজি বিভাগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্ছে এক্স-রে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এক্স-রে করাতে এসেছেন অনেকেই। এ সময় বাড্ডা থেকে আসা ৪৪ বছরের রুম্পা বেগম বলেন, ছোট বোনের বেশ কিছুদিন থেকেই জ্বর-কাশি। ডাক্তার বুকের একটা এক্স-রে করতে দিয়েছেন। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সিরিয়ালই পাচ্ছি না। ভাবছি চলে যাব কি না। 

শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়। রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে এমনকি অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পরও। পর্যাপ্ত পরিমাণে হুইলচেয়ার বা স্ট্রেচার না থাকার গুরুতর রোগীদের কোলে করেও জরুরি বিভাগে নিতে দেখা যায়। রংপুর থেকে আসা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী শোভন সরকারের ছেলে বলেন, সারা রাত জার্নি করে সকালে এসে হাসপাতালে পৌঁছেছি। এখানে আসার পর রোগী যে নামাব তার কোনো উপায় না দেখে আমি আর চাচা মিলে আব্বাকে কোলে করেই জরুরি বিভাগে নিয়ে গিয়েছি। সেখান থেকে ভর্তি করানোর পর ওয়ার্ডেও নিয়ে গিয়েছি কোলে করেই। 

আশপাশে কোনো স্ট্রেচার বা হুইলচেয়ার চোখে না পড়তে একটু সামনে গিয়ে দায়িত্বরত আনসারের কাছে খোঁজ নিলে জানা যায়, আজ শনিবার। তাই আউটসোর্সিংয়ের অনেক কর্মী ছুটিতে। তাই হয়তো চোখে পড়ছে না কাউকে। এমনই থাকে।

তবে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য যাদের লক্ষ করা যায় তারা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সচালক। রোগীদের একপ্রকার জিম্মি করেই উচ্চ ভাড়া আদায় করেন তারা। রাজধানীর শহিদ সোহরাওয়ার্দী থেকে রোগী নিয়ে এসে দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে আসা এক রোগীর স্বজন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো ঢাকা শহর এতটা ভালো চিনি না। দুই হাজার টাকা চাইছিল। শেষমেশ দেড় হাজার টাকায় রাজি হইছে।’ 

সদ্যমৃত রোগীর মরদেহ বাড়িতে নিতে গিয়েও অ্যাম্বুলেন্সচালকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে দেখা যায় স্বজনদের। দিনাজপুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সের চালক ৩২ হাজার টাকা চেয়েছেন জানিয়ে একজন বলেন, এরা মানুষ নাÑ ডাকাত। এদের চোখে জীবন-মৃত্যু কিছুই না। টাকাই সব। এর অন্যতম কারণ অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার কোনো নিয়মনীতি না থাকাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে থাকি। সেবাদানকালে আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হলেও সেগুলোর সমাধানে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখিনি। 

রোগীর চাপ বেশি  থাকলে এ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না বলে জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার শেষ ভরসাস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। আমাদের তীব্র শয্যাসংকট রয়েছে। নেই পর্যাপ্ত জনবলও। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছি। দুর্ঘটনায় আহ তবা জখম, আগুনে দগ্ধ, জটিল ও দুরারোগ্যসহ নানা রোগে আক্রান্ত যেকোনো রোগী এই হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে চিকিৎসাসেবা পাবেনই এমনটা মনে করেন। আর তাই সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রতিদিন বহু রোগী ছুটে আসেন এই হাসপাতালে। আমরাও চেষ্টা করি সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দিতে। যেটুকু সংকট সেটুকু নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!