ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ কমবে

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ০৩:১৯ এএম
ছবি: রূপালি বাংলাদেশ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হতে পারে। যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ রয়েছে ভর্তুকি ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে ৮ হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ হতে পারে নতুন অর্থবছরে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সার্বিকভাবে ভর্তুকি কমানোটা ইতিবাচক। কারণ পর্যায়ক্রমে এই ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সার, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমার প্রবণতায় রয়েছে। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তা ছাড়া এই দুই খাতসহ সার্বিক ভর্তুকি কমিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাকিত মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। ভর্তুকিসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের কয়েকটি বিষয় নিয়ে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ফলে সরকার যতটা পারে আন্তর্জাতিক এই সংস্থার পরামর্শ মেনে চলতে চাচ্ছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনার বড় অংশই বরাদ্দ রাখা হতে পারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষি খাতে। এ খাতে ভর্তুকি ছাড়াও সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও ভর্তুকি বরাদ্দ থাকবে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ বা এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে রেখে রপ্তানি প্রণোদনায় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৭১ হাজার কোটি টাকা আর প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ভর্তুকিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ বরাদ্দ ছিল প্রণোদনা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমানো হয়েছে। এতে কৃষি খাতে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকার ভর্তুকি ও প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সংশোধিত বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ২৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল চলতি অর্থবছরের চেয়ে যা কম। চলতি অর্থবছরে প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের এই খাতেও দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের প্রভাব স্পষ্ট। আইএমএফের শর্ত ছিল, এ ধরনের খাতে ব্যয় কমানো।

আইএমএফ ভর্তুকি প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও সরকার কেন বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে জানতে চাইলে, অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ভর্তুকি একবারে হঠাৎ করে বাদ দেওয়া যায় না, পর্যায়ক্রমে তা বন্ধ করা উচিত। অন্যথায়, এ ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তারা বলেন, ভর্তুকির অনেকটা অপচয় হয়। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির অপচয় সবচেয়ে বেশি। এসব অদক্ষতা দূর করতে পারলে ভর্তুকি কমিয়ে আনা সম্ভব। সারের ভর্তুকিতেও বিপুল অপচয় হচ্ছে। কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করছে। এতে উৎপাদনও কমছে, মাটি নষ্ট হচ্ছে, ভর্তুকিও বাড়ছে। তাই সারে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ আছে।

প্রতি বছরের জাতীয় বাজেটেই ভর্তুকি বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়। কৃষি খাতে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্যই মূলত বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই আপত্তি তুলে আসছে দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। তাই আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সরকার ভর্তুকির বোঝা কমানোর দিকে বেশ জোর দেবে বলে জানা গেছে। নতুন ওই বাজেটে ভর্তুকি খাতের বরাদ্দ টাইট করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। 
এদিকে ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হতে পারে, তখন থেকে রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে না সরকার। তখন হঠাৎ করে রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হলে শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিবর্তন মোকাবিলায় রপ্তানি খাতকে প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার ইতোমধ্যেই চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে রপ্তানি প্রণোদনার হার কমিয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা কমানো হতে পারে।

বাজেটে রপ্তানি প্রণোদনা হিসেবে অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও এ খাতে ব্যয় কত হবে, তা নির্ভর করবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ওপর। প্রবৃদ্ধি বাড়লে প্রণোদনায় ব্যয়ও বাড়ে। তবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে যে ঘটনা ঘটছে তাতে রপ্তানি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যয়ও কমতে পারে।

উল্লেখ্য, আইএমএফ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে দুটি কিস্তিতে ১১৬ কোটি ডলার পেয়েছে। তৃতীয় কিস্তি বাবদ আরও ১১৫ কোটি ডলার জুনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। ওই ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এখন অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা শুরু হয়েছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপও বেড়েছে।