ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

ক্রমেই গ্রাহক হারাচ্ছে বাংলালিংক ও রবি

শাওন সোলায়মান 
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৫, ১২:৫৬ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গ্রাহকসংখ্যার বিবেচনায় বিগত কয়েক মাসের হিসাব বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ক্রমেই গ্রাহক হারাচ্ছে দেশের দুই মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) বাংলালিংক ও রবি। তবে গ্রাহক বাড়ছে আরেক অপারেটর গ্রামীণফোনের। তবে গ্রাহকসংখ্যা ওঠানামা করছে একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের। 

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে আসে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে দেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর গ্রাহকপ্রতি আয় এবং কথা বলার হার কমেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন চিত্র দেখা যায়। একই সময়ে ডেটা রেভিনিউ, গ্রাহকসংখ্যাতেও মিশ্র ফলাফল দেখছে অপারেটরগুলো। 

গ্রামীণফোনের সবশেষ ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর অপারেটরটি গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৪৩ লাখ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গ্রাহকের এই সংখ্যা গ্রামীণফোনের জন্য ছিল ৮ কোটি ২২ লাখ। অর্থাৎ ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে গ্রামীণফোনের গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে অপারেটরটির ৪জি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখে। গ্রাহক বাড়লেও গত বছর প্রতি গ্রাহকের বিপরীতে অপারেটরটির রাজস্ব আয় কমেছে। ২০২৪ সালে এই রাজস্ব আয় ছিল গ্রাহকপ্রতি ১৫৫ টাকা, যা এর আগের বছর ছিল ১৬১ টাকা। গত বছর গ্রামীণফোনের গ্রাহকপ্রতি কথা বলার হার ছিল ১৭৬ মিনিট, যা আগের বছর ছিল ১৮৯ মিনিট। 

প্রতিবেদনে গ্রামীণফোন জানায়, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিকূল বাজার পরিবেশের কারণে গ্রাহকপ্রতি আয় ও বিভিন্ন অনলাইন কল ও মেসেজিং সার্ভিসের ব্যবহার বাড়ার কারণে গ্রাহকপ্রতি কথা বলার হার কমে এসেছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালে গ্রামীণফোনের ডেটা রেভিনিউ কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকের ওপর গ্রামীণফোনের আর্থিক বিবরণীতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বলেন, ‘চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও কৌশলগত উদ্যোগের মাধ্যমে আর্থিক কর্মক্ষমতা উন্নত হচ্ছে। এই প্রান্তিকেও ইন্টারনেটের গ্রাহকসংখ্যা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটের মূল্য ১৭ শতাংশ হ্রাসের প্রভাবে গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় রাজস্ব কমেছে। তথ্য-প্রযুক্তি ও নেটওয়ার্ক অবকাঠামো রূপান্তরের মধ্য দিয়ে উদ্ভাবনের এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি, যা দেশে একটি ডেটা ও ডিজিটালকেন্দ্রিক অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করছে। প্রযুক্তিগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতি প্রান্তিকেই কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছি, যা গ্রাহকদের আমাদের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি  নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী অভিজ্ঞতা প্রদান করছে।’

গ্রাহকপ্রতি আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটর রবির ক্ষেত্রেও। ২০২৪ সালে গ্রাহকপ্রতি রবির রাজস্ব আয় ছিল ১৩৭ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৪২ টাকা। ওই বছর রবির গ্রাহকপ্রতি কথা বলার হার ছিল ১৪৯ মিনিট, যা ২০১৩ সালে ছিল ১৫৫ মিনিট। রবির প্রতিবেদনেও বিভিন্ন অনলাইন কল ও মেসেজিং সার্ভিসের ব্যবহার বাড়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রাহকপ্রতি রাজস্ব আয় ও কথা বলার হারের পাশাপাশি ২০২৪ সালে গ্রাহক সংখ্যায়ও নেতিবাচক দৃশ্য দেখেছে রবি। 

সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৪ সালে অপারেটরটির গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ, যা ২০২৩ সালে ছিল ৫ কোটি ৮৭ লাখ। দেখা যায়, এক বছরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটরটি গ্রাহক হারিয়েছে প্রায় ২০ লাখ। তবে এই সময়ে অপারেটরটির ৪জি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখে। ২০২৪ সালের প্রথম মাসে রবির গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮৩ লাখ। চলতি বছরের প্রথম মাসে রবির গ্রাহকসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৪ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ। 

গ্রাহকসংখ্যা কমার পেছনে সিমের ওপর কর বৃদ্ধি এবং বৈষম্যমূলক বাজারব্যবস্থাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছে রবি। প্রতিষ্ঠানটির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সিম কর বৃদ্ধি এবং বৈষম্যমূলক বাজার ব্যবস্থার ফলে গ্রাহকেরা নতুন সংযোগ কিংবা একাধিক সিম ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছেন। সিমের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মোবাইল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত রাখা এখন আরও কঠিন। একই সঙ্গে খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রয়োজন হলেও অনেকেই বিকল্প সংযোগ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে অনেক গ্রাহক তাদের পুরোনো সিমে ফিরে যাচ্ছেন এবং সেটিতেই স্থির থাকছেন, যার প্রভাবে সামগ্রিকভাবে সংযোগের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত জুলাই-আগস্টে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে যেসব সিম বন্ধ হয়েছিল, সেসব গ্রাহকের অনেকেই আর ফেরত আসেনি।’ সাহেদ আলম আরও বলেন, ‘রবির বিস্তৃত ও শক্তিশালী ৪.৫জি নেটওয়ার্ক কাভারেজ এবং ৪জি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ার ফলে গ্রাহকপ্রতি ডেটা ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি, ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও স্ট্রিমিং, গেমিং ও সোশ্যাল মিডিয়ার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, যা ডেটা ব্যবহারের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে রবির ডেটা রেভিনিউ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সামগ্রিক ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গ্রাহকেরা আগের তুলনায় কম ভয়েস কল করছেন, এর ফলে গ্রাহকপ্রতি গড় আয় (এআরপিইউ) এবং এভারেজ মার্জিন পার ইউজার (এমপিইউ) কমে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রতিফলন।

দেশের আরেক মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের ২০২৪ সালে গ্রাহকপ্রতি আয়ের পরিমাণ ছিল ১২৯ টাকা, যা আগের বছরও একই ছিল বলে দেখা যায় অপারেটরটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান ভিওনের প্রতিবেদনে। যদিও প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকপ্রতি আয়ের পরিমাণ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা এবং নাগরিক বিক্ষোভের কারণে এমন চিত্র দেখা গেছে।

২০২৪ সালে বাংলালিংকের গ্রাহকপ্রতি কথা বলার হার ছিল ১৫৪ মিনিট, যা আগের বছর ১৫৮ মিনিট। গ্রাহকপ্রতি আয় ও কথা বলার হারের পাশাপাশি গ্রাহকসংখ্যায়ও নেতিবাচক সূচক দেখছে বাংলালিংক। ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে অপারেটরটির গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩৫ লাখ। তবে ভিওনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে অপারেটরটি গ্রাহকসংখ্যা ৪ কোটি ৪ লাখ, ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে অপারেটরটি গ্রাহকসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫৮ লাখ। দেখা যায়, এক বছরে বাংলালিংক হারিয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ গ্রাহক। এ ছাড়া বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসেই গ্রাহকসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বাংলালিংকের। গ্রাহক হারানোর পাশাপাশি গ্রাহকপ্রতি মোবাইল ডেটা ব্যবহারেও নেতিবাচক চিত্র দেখেছে বাংলালিংক। ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গ্রাহকপ্রতি মাসিক মোবাইল ডেটা ব্যবহারের হার ছিল ৫ দশমিক ৪ জিবি। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে এটি কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১ জিবিতে। গত জুনে বাংলালিংকের গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪৪ লাখ, যা কমতে কমতে গত ফেব্রুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৬ লাখে নেমে আসে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলালিংকের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বাংলাদেশের টেলিকম শিল্প প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বিশ্বের মধ্যে অন্যতম টেলিকম করের বোঝার কারণে এমনটা দেখা যায়। এর ফলে গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং গ্রাহক বৃদ্ধির হার ও টেলিকম সেবা ব্যবহারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়।’ বাংলালিংক আরও জানায়, ‘বাংলাদেশের স্পেকট্রাম খরচ আঞ্চলিক বাজারগুলোর তুলনায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, যা অপারেটরদের জন্য সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করা ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে। শিল্পে স্থিতিশীলতা এবং গ্রাহকদের উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে একটি ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন।’