অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাস পরও থামেনি রাজনৈতিক অস্থিরতা। সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে বেড়েই চলেছে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ গণপিটুনির ঘটনা। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের আইনশৃঙ্খলার ওপর আস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সর্বস্তরের মানুষ। আতঙ্ক বেড়েছে সাধারণ বা রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝেও।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিকসহ সৃষ্ট সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ ছাড়াও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে হতাহতের ঘটনা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে দুষ্কৃতকারীদের হাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা।
সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার একটি তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলকে কেন্দ্র করে এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। মার্চে গণপিটুনির সংখ্যা বেশি, এতে বিএনপির নেতাকর্মীরাই বেশি মারা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। অপরাধ বিশ্লষকেরা বলছেন, দেশজুড়ে বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, সেই সঙ্গে বাড়ছে গণপিটুনি। সেটা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বেশকিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব রাজনৈতিক সহিংসতায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশি মারা গেলেও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ অনেকটা কমেছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে কমপক্ষে ৩২৫টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪৭ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি কমপক্ষে ২৪৫ জন আহত হয়েছেন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপির ৩১ জন, আওয়ামী লীগের ১০ জন, জামায়াতে ইসলামীর ১ জন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ১ জন এবং ইউপিডিএফের ২ জন। অপর ২ জনের রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি, যার মধ্যে একজন নারী রয়েছেন।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, চলতি মার্চ মাসে অন্তত ৩৯টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ১৩ জন নিহত ও ৫৬ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ৪০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ৭ জন ডাকাত সন্দেহে, ২ জন চুরির অভিযোগে, ১ জন রাজনৈতিক কারণে, ১ জন ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ১ জন অতিরিক্ত মদপানের অভিযোগে এবং ১ জনকে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
অপরদিকে ১৯ জন ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ৪ জন যৌন হয়রানির অভিযোগে, ৪ জন ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ১৪ জন ডাকাতির অভিযোগে এবং সন্দেহজনক চুরি, ছিনতাইয়ে এ ধরনের অপরাধজনিত কারণে ১৫ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।
দলীয় কোন্দলে আট মাসে বিএনপির ৫১ নেতাকর্মী নিহত: কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত আট মাসে সংর্ঘষে ৫১ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন চার শতাধিক নেতাকর্মী-সমর্থক।
দলীয় সূত্র জানায়, এসব ঘটনা সিলেট, কুমিল্লা, মাদারীপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, যশোর, রংপুর, বাগেরহাট, ফরিদপুর, নরসিংদী, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর এবং ঢাকায় বেশি ঘটেছে।
সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি হঠাৎ করে বাড়ছে সহিংসতা, মারামারি ও খুনের মতো ঘটনা। মধ্যরাতে কিংবা ভোরে কোথাও কোথাও ঘটছে গুপ্ত হামলাও। এসব ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ ও আতংক বাড়ছে।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হতে দেখা গেছে। এখন সংকট কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে সক্রিয় হলেও ফের ঘটছে খুনাখুনি ও মারামারির মতো ঘটনা।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থার কোনো ঘাটতি নেই। সারা দেশে দিনে-রাতে পুলিশের প্রয়োজনীয় টহল ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা দেখছেন না অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, সম্প্রতি প্রশাসন কঠোর হলেও কিছুদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ফের খারাপ হতে দেখা গেছে। এজন্য এখনো দুর্বল প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, আমাদের পুলিশের নিরাপত্তার কোনো সংকট নেই বললেই চলে।
তা ছাড়া দেশব্যাপী দিন-রাত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে।
গত শুক্রবার গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারাব গ্রামে ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
নিহত রুবেল মিয়ার (৩২) পরিবারের অভিযোগ, বিএনপি নেতারা তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে রুবেলকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নিহত রুবেল বারাব গ্রামের বাসিন্দা ও দুই নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
রুবেলের স্ত্রী ফারজানা বলেন, গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ১২-১৪ জন বিএনপি নেতাকর্মী বাড়িতে ঢুকে তার স্বামী রুবেলকে মারধর শুরু করেন।
বাধা দিলে হামলাকারীরা বলেন, তোর স্বামী আওয়ামী লীগ করে, এজন্য মাইরা ফেলব।
ফারজানা আরও বলেন, ‘তাদের পায়ে ধরছি, কিন্তু আমার কথা শুনে নাই। আমার স্বামীর কোনো দোষ নাই। শুধু আওয়ামী লীগ করে বলে আমার স্বামীকে তারা মাইরা ফেলাইছে।’
এ বিষয়ে কাপাসিয়া থানার ওসি মুহম্মদ আবদুল বারিক জানান, এ ঘটনায় মামলার পর এজাহারভুক্ত আসামি জিহাদ হোসেন মুন্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
গত ১৯ এপ্রিল রাত পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল মোড়ল গলি এলাকা থেকে মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সরদারকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। আশংকাজনক যুবদলের ওই কর্মী গত গত সোমবার (২১ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীনে মারা যান। হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক মো. রাসেল জানান, গত ১৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরিফকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ ছাড়া গত রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুর টঙ্গী পূর্ব থানার রেল কলোনি বস্তি এলাকায় শত্রুতার জেরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিজন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম জানান, তাদের প্রাথমিক ধারণা পূর্বশত্রুতার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল বিকেলে দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে হাসাহাসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বনানীতে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।
এ সময় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজ নিহত হন। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম অভিযোগ করেন, পারভেজকে হত্যার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জড়িত।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব সহিংসতার নামে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা দেখছি। এটা ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে তৈরি করা হচ্ছে। এসব মব ভায়োলেন্সে কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মব সহিংসতা ছোঁয়াচে রোগের মতো। এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, কোনো অপরাধের তথ্য থাকলে বা কারও বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ থাকলে সুনাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো উচিত।
আপনার মতামত লিখুন :