পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে বাজেট ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ ২০ হাজার টাকা। অথচ খরচ করা হয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ৯৭ হাজার ৫১ টাকা।
অর্থাৎ বাজেটের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১ কোটি ৭০ লাখ ৭৭ হাজার ৫১ টাকা বেশি খরচ করেছে। শুধু ওই অর্থবছর নয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির বাজেট ছিল ১১ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। খরচ করা হয়েছিল ১৩ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ৭০৬ টাকা। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়টি ২ কোটি ৯০ হাজার ৭০৬ টাকা বেশি খরচ করে। দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩ কোটি ৭১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫৭ টাকা বেশি খরচ করেছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনেও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে খাতের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে সেই খাতে ব্যয় করতে হবে।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়ন প্রকল্পে ২০২০-২১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিপিপি মোতাবেক বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। এরপর আবার চুক্তিমূল্য বাড়িয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়াও ঠিকাদারের বিল থেকে জামানত কর্তনের নামে কর্তনযোগ্য জামানতের অতিরিক্ত অর্থ প্রকল্প হিসাব থেকে অনিয়মিতভাবে জামানত হিসাবে স্থানান্তর বাবদ ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ৫৮৬ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদনটি সরকারের হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে জমা দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। প্রতিবেদনটির অনুলিপিও পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে।
অডিট অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৬টি খাতে আয় ও ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৪টি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে অধিদপ্তর। এতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে অন্তত দেড়শ কোটি টাকার। কেন এসব অনিয়ম করা হয়েছে তা জানতে চাইলেও অধিকাংশ বিষয়ে সুস্পষ্ট জবাবও দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ।
এই জবাব না দেওয়ায় অডিট কোডের বিধি ৫৯ ও ট্রেজারি রুলসের অধীন সাবসিডিয়ারি রুলস ৪৩৭ এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অন্যদিকে যেসব খাতে অনিয়ম করে বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে সেই টাকা ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি এসব নির্দেশনা খুব একটা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ একটি সূত্র। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অডিট অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়ন প্রকল্প খাতে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় করায় ক্ষতি হয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা। বাজেট বরাদ্দপত্র ও ব্যয় বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৬ কোটি ৪৮ লাখ ২১ হাজার টাকা।
কিন্তু ওই খাত থেকে ব্যয় হয়েছে ২৩ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। ফলে ওই অর্থবছরে ওই খাতসমূহে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৬২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। কিন্তু ওই খাতগুলো থেকে ৯৫ কোটি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। ওই অর্থবছরেও বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ৪৫ কোটি ৫১ লাখ ৪১ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুবিভাগের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ-২০১৫ মতে, কোনো ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করা এবং বাজেটে বিভিন্ন কোডের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যেই প্রকৃত ব্যয় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনমতে, যে খাতের জন্য অর্থ মঞ্জুর বা বরাদ্দ করা হয়েছে সেই খাতেই ব্যয় করতে হবে। তাই এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর।
এদিকে প্রয়োজনের বাইরে গেস্ট হাউসের নামেও হয়েছে নানা অনিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মকর্তার জন্য পাবনায় ৩৬ হাজার ২৫০ টাকা ভাড়ায় একটি গেস্ট হাউস রয়েছে। এর বাইরে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কাজে ঢাকায় অবস্থানের জন্য তেজগাঁওয়ের ইন্দিরা রোডে ৭৬ হাজার ২৫০ টাকা চুক্তিতে আরেকটি গেস্ট হাউস ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
দুই অর্থবছরের ভাড়া দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। পাবনায় গেস্ট হাউস থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় গেস্ট হাউস নেওয়া অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে অডিট অধিদপ্তর। পদ ছাড়াই অগ্রানোগ্রাম বহির্ভূতভাবে অধ্যাপক, বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে আপগ্রেডেশন করা ১৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা, নিম্নস্তরের কর্মচারীকে উচ্চতর পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করায় ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়াও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, সামাজিকবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অনুষদে ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকার নিম্নমানের বই সরবরাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো বইগুলো সরবরাহ করেনি। নিরীক্ষা দল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গুদাম পরিদর্শন করে দেখেছে, বইগুলো নিম্নমানের কাগজে ফটোকপি করে তৈরি করা হয়েছে।
এর বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষকদের মূল পদের বাইরে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা, একই সময়ে একাধিক দায়িত্বভাতা, ইউজিসির অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বিধিবহির্ভূতভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতনের বাইরে অগ্রিম লোন দিয়ে তা সমন্বয় না করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন বিল থেকে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন না করা, বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যায় করা, ঠিকাদারি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে আয়কর কর্তন না করা, প্রকল্পের অর্থ নিয়ম না মেনে অন্য ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা, প্রকল্পের জামানত থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, ডিপিপি লঙ্ঘন করে উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে সরকারি ক্রয় করা, প্রচার ও বিজ্ঞাপন বিল থেকে সার্ভিস চার্জ কর্তন না করা, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিধিবহির্ভূতভাবে ডিনের দায়িত্ব প্রদান করে দায়িত্ব ভাতা দেওয়া, চুক্তিমূল্যের অতিরিক্ত বিল পরিষোধ করায় অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এসব অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: এ প্রসঙ্গে জানতে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. শামীম আহসানকে মুঠোফোনে কল করলে তিনি ছুটিতে আছেন বলে জানান। একই সঙ্গে মুঠোফোনে এই বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আব্দুল আওয়াল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অনিয়মগুলো আমি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগেই হয়েছে। তাই এ বিষয়টি পুরোপুরি আমার জানা নেই। তবে দুদক এ বিষয়ে কাজ করছে। আমার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিল। আমরা সেই তথ্যগুলো যথাযথভাবে প্রধান করেছি।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জবাব দেবে। ইউজিসিও এসব আর্থিক অনিয়মকে কোনো প্রশ্রয় দেবে না। আমরাও ব্যবস্থা নেব।
আপনার মতামত লিখুন :