সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, মার্চ মাসেই উৎপাদনে আসবে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এমনকি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার রোসাটম থেকে খোদ প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছিল যে শেষ হয়ে গেছে এর নির্মাণকাজ।
এই কেন্দ্র নির্মাণের তদারকিতে নিয়োজিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ায় উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা।
তাদের দাবি, ওই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আনার জন্য সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ। বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজই বাকি। আর তাই উদ্বোধন সম্ভব হচ্ছে না। দুই মন্ত্রণালয়ের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের কারণেই দেশের জ্বালানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার এই প্রকল্প উদ্বোধন চলতি বছরে হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কেন্দ্রটির বেশির ভাগ কর্মীই পার করছেন অলস সময়।
এতদিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের তিনটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটির কাজ শেষ হলেও বাকি একটি লাইনের (রূপপুর-গোপালগঞ্জ) কাজ শেষ হয়নি।
ফলে উৎপাদন শুরু করতে পারলেও এর বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া অনিশ্চিত। যেহেতু এটি পারমাণবিক জ¦ালানি (ইউরেনিয়াম) দিয়ে চলবে, তাই একবার চালু হলে আর বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই যতক্ষণ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদন শুরু করা যাবে না।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাশিয়ার স্টেট করপোরেশন ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচোভ জানিয়েছেন, প্রকল্পের ড্রাই রান চলছে। শিগগিরই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি আশ্বাস দেন, রোসাটম নিরাপত্তা, গুণমান ও আন্তর্জাতিক মান মেনে চলার দিকে মনোনিবেশ করে প্রকল্পটির সমাপ্তিতে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টাও যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া রোসাটমকে ধন্যবাদ জানান।
কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করে আসছিলেন, প্রথম ইউনিটের জন্য তিনটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটির কাজ শেষ হলেও বাকি একটি লাইনের (রূপপুর-গোপালগঞ্জ) কাজ শেষ হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করার জন্য যমুনা ও পদ্মা রিভার ক্রসিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
একটি পিলারের কাজ সম্পূর্ণ বাকি রয়ে গেছে। ফলে রূপপুরের কমিশনিং, ফিজিক্যাল স্টার্টআপ, ফুয়েল লোডিং ও আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণ সম্পন্ন সাপেক্ষে কেন্দ্রটি চালু করতে চলতি বছরের শেষ হয়ে যেতে পারে।
এটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দাবি করে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে প্রস্তুত। সঞ্চালন লাইনের কাজ যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকু শেষ হয়েছে গত মাসেই। মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই কিছু কাজ বাকি থাকায় তারা উৎপাদনে আসতে পারছে না।
তিনি পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশকে (পিজিবি) উদ্ধৃত করে জানান, রূপপুর পারমণাবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ হয়েছে সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে। এর মধ্যে রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের অগ্রগতি শতভাগ।
আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার নির্মাণকাজও শেষ। রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ১৪৭ কিলোমিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার, ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটার, বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার এবং ৯টি বে এক্সটেনশন নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। পদ্মা নদীর ওপর যে দুটি সঞ্চালন লাইনের কাজ চলছিল, চলতি মাসে সেটিও শেষ হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে আর খুব বেশি কাজ বাকি নেই। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চাইলেই উৎপাদনে আসতে পারে।
সব মিলিয়ে স্থলভাগের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. মাসুদুল ইসলামও। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এখন ছোট ছোট কিছু কাজ বাকি রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র যেদিন চাইবে, সেদিনই জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত পিজিবি।
তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বললেন ভিন্ন কথা। রূপালী বাংলাদেশকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সঞ্চালন লাইনের কাজ যে শেষ হয়নি এটি তো দৃশ্যমান। পদ্মা নদীর ওপর যে কেউ দেখতে পাবে যে এখনো একটি পিলার তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে পিজিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, তাদের শেষের পিলারটার কাজ চলছে। বেইজ হয়ে গেছে। এখন টাওয়ার লাগানোর পর তার টানার কাজ শুরু হবে বলে তিনি আমাকে জানিয়েছেন। এটা গত শনিবারের কথা।’
এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উপদেষ্টার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কাজের অগ্রগতি এটাই। এ ব্যাপারে কে কী বলেছে, তা আমাদের দেখার বিষয় না। মূল চিত্রটা তো পিজিবির এমডি আমাকে জানিয়েছেন গত শনিবারই। পদ্মা নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত চারটি পিলার দুটি দুই পারে, দুটি মাঝখানে। এর মধ্যে তিনটা হয়ে গেছে। নদীর মাঝখানের টাওয়ার লাগানোর কাজ চলমান। টাওয়ার লাগানোর কাজ শেষ হলে তার টানা হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় (মঙ্গলবার) এমডির সঙ্গে আবার দেখা হবে। তখন আবার অগ্রগতি জানতে চাইব।’ তাহলে কি কেন্দ্রের কাজ শতভাগ শেষ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে হ্যাঁ বা না দিয়ে উত্তর দেওয়া সম্ভব না। এখানে গ্রিড লাইন সিনক্রোনাইজেশনের বিষয় আছে। গ্রিড লাইন তৈরি না হলে কিছু বিষয় পরীক্ষা করা যাবে না।
শতভাগের যে বিষয়টা বলছেন, সেটা শেষের ৩ শতাংশ কাজ লাইন টানার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই টেকনিক্যাল বিষয়ে শতাংশের হিসাবে বলা সম্ভব নয়। আমাদের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন যেটি আছে, তা নদীর দুই পাশে লাইন লাগানোর পরে এখানে সিনক্রোনাইজেশন হবে, ট্রায়াল হবে। এসব কাজ বাকি আছে। এটা তো পারমাণবিক জ্বালানি এ বিষয়টা আমাদের বুঝতে হবে। এটা আমাদের সবার জন্যই নতুন। রিয়েক্টর ভ্যাসেল একবার চালু হলে সেটি তো আর বন্ধ করা যাবে না।’
এর আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টাও বলেছিলেন মে মাসে উদ্বোধনের কথা। তাহলে সেটি সম্ভব হলো না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি তিনি পিজিবির তথ্যের ভিত্তিতেই বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পদ্মা নদীর পানির ফ্লো বেশি থাকায় তারা এটির কাজ শেষ করতে পারেনি। আর গ্রিড লাইন তৈরির কাজ শেষ না হলে তো পরীক্ষামূলকভাবেও উৎপাদন সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘পরমাণু কর্মসূচি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ ধরনের প্রকল্প চালুর ক্ষেত্রে গ্রিড, টেলিকমিউনিকেশন, ভৌত নিরাপত্তাসহ নানান বিষয় রয়েছে। খোদ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির তত্ত্বাবধানে রয়েছি আমরা। তারা সার্বক্ষণিক আমাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছে।
তাই বিষয়টা এত সহজ না। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পরও ৯৩ দিনের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এর পরই তা জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হবে। তাই আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের আগে এটির উদ্বোধন সম্ভব না।’
পিজিবি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিডলাইন প্রকল্প শুরুতে ভারতীয় ঋণে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঋণছাড় দীর্ঘায়িত করায় বাংলাদেশ সরকার পরে গ্রিডলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ থেকে বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পে কর্মকর্তাদের যোগ দেওয়ায় ধীরগতি নামে। এতে পিছিয়ে পড়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ।
বর্তমানে পিজিবি ও সরকারের অর্থায়নে গ্রিড লাইনের কাজ চলছে। সঞ্চালন লাইনের কাজের বিপরীতে এখন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে সঞ্চালন লাইনের ঠিকাদারের বিল বকেয়া ২৫ মিলিয়ন ডলার। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে পিজিবি বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে ২৫ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের অনুরোধ জানিয়েছে।
তবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে শুধু সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়াই একমাত্র বড় প্রতিবন্ধকতা নয়। এর সঙ্গে নিরাপত্তাব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামো, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম ও কেন্দ্র চালুর জন্য বিকল্প হিসেবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখারও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
জানা গেছে, পারমাণবিক কেন্দ্রটি চালাতে হলে বিকল্প হিসেবে অন্তত ১ হাজার ৯০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে হবে। সম্প্রতি রুশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য হলো, কোনো কারণে রূপপুরে বিঘ্ন ঘটলে বিকল্প কেন্দ্র থেকে যেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সে জন্যই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে হবে। এ ধরনের বিকল্পকে স্পিনিং রিজার্ভ বলা হয়।
২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের সঙ্গে এতদিন সঞ্চালন লাইনের কাজও তাল মিলিয়ে চলছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে, সেটি নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা আশা করছিলাম গত বছরের ডিসেম্বরেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
কিন্তু যেহেতু একটা গণঅভ্যুত্থান দেশে হয়ে গেছে, তাই কিছুটা স্থবিরতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকার এই সংকট কাটিয়ে উঠবে এবং শিগগিরই সঞ্চালন লাইনের কাজও শেষ হবে।’
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটের সক্ষমতা মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
চলতি বছরে প্রথম ইউনিট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কংক্রিট ঢালাইয়ের মধ্য দিয়ে রূপপুর প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। পরবর্তী বছর ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করা হয়।