স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে নতুন সরকার ১৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে। সেই থেকে দুই ধারার নীতির কোনো পরিবর্তন করেনি এনবিআর। তবুও বার্ষিক রাজস্ব গড়ে প্রায় ১৪ ভাগ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘাটতি থাকলেও ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে এনবিআর।
তবে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় টেকসই করতে কিছু নীতির পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন বাস্তবতায় রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব বাস্তবায়ন পৃথকীকরণ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫ সদস্যবিশিষ্ট পারমর্শক কমিটি গঠন করেছে এনবিআর। তবে সেখানে প্রয়োগিক বাস্তবায়নের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিসিএস কর্তারা স্থান পাবেন বলে জানিয়েছে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন। তবে পৃথক পদবিতে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বায়নের যুগে গুরুত্ব বিবেচনায় কর-রাজস্ব আহরণ ও ব্যবস্থাপনায় এবং রাজস্ব নীতি প্রণয়ন আলাদা হচ্ছে। প্রয়োগিক বাস্তবায়নের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের সদস্যদের মধ্য থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের শীর্ষ পদগুলো পূরণ করা হবে।
অন্যসব অনুবিভাগের নীতিনির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পদগুলো পূরণে প্রস্তাবিত বিভাগ দুটিকে কার্যকর, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব, গতিশীল এবং অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে জনমুখী করতে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিবার। অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন উদ্যোগ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির সহায়ক হবে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
পরিবর্তিত নীতিতে কর্মীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘আইনের খসড়া করেছি। শিগগিরই দুটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এখানে বাইরের এক্সপার্ট লোকও থাকবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় যারা অভিজ্ঞ, তারাই এখানে থাকবেন। এভাবেই আমরা ডিজাইন করেছি।’
রাজস্ব সেবায় ‘ট্যাক্স সৈনিক’ বা কর্মীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের মেধা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে তারা কাজ করতে পারেনি। এখন থেকে তারা আরও ভালোভাবে কাজ করবেন। তবে গর্হিত কাজ থেকে ট্যাক্স সৈনিকদের দূরে থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কর অব্যাহতির চেষ্টা করছি, এটা থেকে বের হতে হবে। আমাদের অনেক আইন আছে কিন্তু আইনের সুশাসনের অভাব। তাই সরকারি ইনসেনটিভ দিলেও বিদেশি বিনিয়োগ এখানে আসবে কি না, সন্দেহ রয়েছে। কাজেই আমাদের আগে কিছু সংস্কারে হাত দিতে হচ্ছে।’
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষভাগে অর্থাৎ আট মাস (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শেষে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি পিছিয়ে আছে এনবিআর। গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করলেও বিগত বছরগুলোতেও টানা ঘাটতির মুখে ছিল। অর্থবছরের ৬ মাস শেষেও ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘাটতি ছিল প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। আগামীতে যেন এমন রাজস্ব ঘাটতিতে না পড়তে হয়, সেজন্য নতুন নীতি আরোপ করেছে সংস্থাটি।
‘রাজস্ব আহরণ টেকসই করতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ বলেন এনবিআরের সদস্য জিএম আবুল কালাম কায়কোবাদ। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আইএমএফের নির্দেশনায় পলিসিগত কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও এ নিয়ে কাজ করছে এনবিআরও তারই একটি অংশ পালন করছে’ বলেন তিনি।
রাজস্ব ঘাটতির বিষয়ে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল একটি বড় কারণ। সে সময়ে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ে, যার কারণে সেই প্রভাব সব ক্ষেত্রে ছড়িয়েছে।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ গঠনের মূল লক্ষ্য নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথককরণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষায়িত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও ব্যবসাবান্ধব রাজস্বনীতি প্রণয়ন হবে।
এদিকে, রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো হলো বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডার থেকে পূরণের প্রস্তাব করা হলেও খসড়ার অনুচ্ছেদ ৪(৪)এ আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, অডিট, আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা থেকে পূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
তবে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি’ বলে জানান সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ। ‘নীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন মৌলিক পদে বর্তমানে দায়িত্ব পালনরত রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের রাখা হয়নি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নীতিনির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পর্যায়ে এই দুই ক্যাডারভুক্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ করা দরকার। নতুন নীতিতে মাঠের অভিজ্ঞতা ও নীতির মধ্যে মারাত্মক ব্যবধান থাকছে। যা রাজস্ব সংস্কারের মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করবে বলে আশংকা রয়েছে।’
তবে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন কিছু প্রতিবদ্ধকতা তুলে ধরেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাল্টিপারপাস হলে গত শনিবার এ বিষয়ে বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) করেছে সংগঠনের নেতারা। বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনে সভায় বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
তারা মনে করেন, কর-রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা দীর্ঘমেয়াদে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর, কাস্টমস মূল্যায়ন, পণ্য শ্রেণিবিন্যাস, আমদানি-রপ্তানি, প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেন। এই দক্ষতা রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসহ নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও নীতি প্রণয়নের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
খসড়ার অনুচ্ছেদ ৯-এ রাজস্ব নীতি বিভাগে জনবল পদায়নের নিমিত্ত সুপারিশের লক্ষ্যে একটি কমিটির কথা উল্লেখ থাকলেও ধারা ৪(৪)-এ এমন কোনো কমিটির উল্লেখ নেই।
খসড়ার অনুচ্ছেদ ৫-এর দফা (চ)-এ রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে ‘কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ’ যুক্ত করা হয়েছে। কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিবীক্ষণ-এর বিধান রাখায় নীতি বিভাগকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম তদারকির সুযোগ থেকে যায়। এক বিভাগের কার্যক্রম সমমর্যাদাসম্পন্ন অপর বিভাগ কর্তৃক পরিবীক্ষণের বিধান রাখা হলে তা আইনের দৃষ্টিতেও সাংঘর্ষিক বিবেচিত হয়।
খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৩)-এ ‘বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ হতে রাজস্ব আহরণে ন্যূনতম ২০ (বিশ) বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পালাক্রমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব হিসেবে নিয়োগ প্রদান’-এর পরিবর্তে ‘রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব/সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান’-এর বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে কর-রাজস্ব আহরণের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়, এমন কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার সৃষ্টি হতে পারে, যা কর-রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত করবে।
খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৫)-এ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদসমূহে প্রশাসন ক্যাডার হতে পদায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পদস্থ রয়েছেন, যা তাদের নির্ধারিত পদ। কিন্তু খসড়ায় প্রশাসনিক পদসমূহে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা থেকে পূরণের সুযোগ রাখা হয়নি।
বিশেষায়িত দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিদ্যমান জনবলের ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্যারিয়ার প্লানিং ও পেশাগত স্বার্থরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক পদসমূহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারভুক্ত জনবল হতে পূরণ করা বাঞ্ছনীয় বলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
এ ছাড়া, সরকার গঠিত রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন অন্যান্য সংস্কার কমিশনের মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করা সমীচীন বলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
আপনার মতামত লিখুন :