সাবমেরিন বা ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) থেকে অফিস, আদালত, বাসাবাড়িতে সর্বস্তরের জনগণের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটররা। আর এই এনটিটিএন জগতের বেশ আস্থাভাজন নাম ফাইবার অ্যাট হোম।
২০০৮ সালে মাত্র দুইটি অপারেটরের মাধ্যমে দেশে বেসরকারি খাতের এনটিটিএন এর যাত্রা শুরু। আর সেই যাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি। শহর থেকে ইউনিয়নে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন কাজ করছে সুলভ মূল্যে গুণগত ইন্টারনেটের বিস্তারে। এজন্য সম্প্রতি ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থার তিন স্তরে মূল্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে ফাইবার অ্যাট হোম। এমন প্রেক্ষাপটেই ইনফোটেক এর সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অংশ নেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ অব গভর্মেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা আব্বাস ফারুক। সাক্ষাৎকার নেন ইনফোটেক ইনচার্জ শাওন সোলায়মান।
বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনে এবং ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থায় ফাইবার অ্যাট হোমের ভূমিকা এবং অবদান কী?
দেশজুড়ে ৬০ হাজার কিলোমিটারের বেশি ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে রোবাস্ট নেটওয়ার্ক রয়েছে ফাইবার অ্যাট হোমের। ৬৪টি জেলার ৪৯৫টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়নে আমাদের ‘ফুটপ্রিন্ট’ আছে; মাল্টিপল ম্যাশ-নেটওয়ার্ক আছে। সড়কে যেমন- যানবাহন চলে তেমনি দেশজুড়ে ইন্টারনেট সঞ্চালনের জন্য ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে ফাইবার অ্যাট হোম। এই ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই এনটিটিএন গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের সেবাগ্রহীতা টেলিকম অপারেটর ও লাইসেন্সি এবং অনুমোদিত অন্যান্য সংস্থা ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পেয়ে থাকে। সেদিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনে এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে ফাইবার অ্যাট হোম সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছে।
যে প্রত্যাশা নিয়ে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?
২০০৮ সালে সরকার এনটিটিএন লাইসেন্স দিয়েছিল। যে বাধ্যবাধকতা এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এই লাইসেন্স দিয়েছিল, তার শতভাগ ফাইবার অ্যাট হোম পূরণ করেছে। শর্ত পূরণ করেছি বলেই সরকার ব্যাংক গ্যারান্টি ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, হয়তো আরও ভালো করতে পারতাম। আগের সরকার যে তিনটি উদ্দেশ্যে এনটিটিএন লাইসেন্স দিয়েছিল, সেগুলো আওয়ামী সরকার নিজেরাই বাস্তবায়ন করেনি। বিশেষ করে ‘সেপারেশন অব নেটওয়ার্ক’ বাস্তবায়ন হয়নি। এর উল্টোটা হলে আরও সুলভ মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক দেওয়া যেত। কারণ সবাই আলাদা করে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক না বসিয়ে, ‘কমন নেটওয়ার্ক’ এর মধ্যে সবার ইন্টারনেট গেলে খরচ কমে আসত।
এনটিটিএনদের বিরুদ্ধে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এনএনও) অভিযোগ যে, আপনাদের কারণে তারা ‘লাস্ট মাইল এন্ড’ এ সংযোগ দিতে পারত না এতদিন। এজন্য ইন্টারনেটের খরচও বাড়ত। আপনি এই অভিযোগকে কীভাবে দেখেন?
এমএনওদের ‘লাস্টমাইল এন্ড’ বলতে আসলে কিছু নেই। ব্যবহারকারীর মোবাইল ডিভাইস থেকে টাওয়ারকে লাস্টমাইল এন্ড বলা যেতে পারে, তবে সেটি ওয়্যারলেস (তারবিহীন)। তাহলে সেখানে এনটিটিএন কী সমস্যা করছে? বরং মোবাইল টাওয়ারগুলো পর্যন্ত ট্রান্সমিশন পৌঁছে দিচ্ছে এনটিটিএন অপারেটরগুলো।
আর যদি আইএসপিদের (ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানকারী) কথা বলেন, তাহলে তাদের জন্য ‘এফটিটিএইচ’ (ফাইবার টু দ্যা হোম’ ব্যবস্থা করে দিয়েছি আমরা। এই ব্যবস্থায় আইএসপিরা তাদের ব্যবহারকারী বা গ্রাহকদের সঙ্গে সহজেই যুক্ত হতে পারেন। মাথার ওপর থেকে তারের জঞ্জাল নামানোর কথা যে আমরা বলি, সেটা সম্ভব এই ব্যবস্থায়। এর সফল পাইলটিং এর নজির রয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন, একটি ভবনের একেক ফ্ল্যাটে আলাদা আলাদা করে ফাইবার টানা থাকে।
ব্যবহারকারী একটি আইএসপি পরিবর্তন করতে চাইলে, পুরোনো তার প্রথমে খুলে নিতে হয়। নতুন আইএসপি আবার নতুন করে তার টানে। এতে খরচ বাড়ে, তারের জঞ্জাল ঘন হয়। এফটিটিএইচ এর দারুণ সমাধান। এমএনপি (মোবাইল নেটওয়ার্ক পোর্টেবিলিটি) সেবার আওতায় যেমন সিম কার্ড পরিবর্তন না করেই যেকোনো অপারেটরে সুইচ করা যায়, তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়তি তারের জঞ্জাল ছাড়াই আইএসপি পরিবর্তন করতে পারবেন। এটাকে বড় পরিসরে সফল করতে প্রয়োজন সরকারের নীতিগত সহায়তা।
সম্প্রতি এমএনওদেরকে ডিডব্লিউডিএম এবং ডার্ক কোর ফাইবার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বিটিআরসি। বলা হচ্ছে, এতে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমবে? আপনার মতামত কী?
‘ডেন্স ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং’ বা ডিডব্লিউডিএম ট্রান্সমিশন ডিভাইস। এনটিটিএন গাইডলাইনের অনুচ্ছেদ ৩.০১ এ স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, এনটিটিএন অপারেটর ছাড়া কেউ ট্রান্সমিশন তৈরি, উন্নয়ন, পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনা করতে পারবে না। অন্যদিকে এনটিটিএন এর ট্যারিফ তালিকায় ডার্ক কোর ফাইবার নাই। তাই এমএনওদের এই দুইটি সুবিধা দেওয়া গাইডলাইনের পরিপন্থি। এনটিটিএন ব্যবসায়ীরা মূলত স্থানীয় উদ্যোক্তা, অন্যদিকে এমএনওরা বিদেশি।
অথচ টেলিকম পলিসিতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার উল্লেখ আছে। কিন্তু এমএনওদের এধরনের সুবিধা দেওয়া পলিসির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি এতে সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের খুব একটা সুবিধা দেখছি না। কারণ কমন নেটওয়ার্কের তুলনায় একেক অপারেটরের একেক নেটওয়ার্ক স্থাপন, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা খরচ কম হতে পারে না। এমএনওদের যে খরচ বাড়বে, সেটা গ্রাহকদেরকেই পরিশোধ করতে হবে।
তাহলে এই সিদ্ধান্ত কীভাবে মেনে নিচ্ছেন?
আমরা আশাবাদী হয়েছি বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) চেয়ারম্যানের একটি কথায়। এসব সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি এমএনওদেরকে বলেছেন, আগামী ১ বছরের মধ্যে তাদের যত ফাইবার আছে, সেগুলো এনটিটিএন এর আওতায় আনতে হবে।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ তৈয়্যব জানিয়েছেন যে, আপনারা তিনটি স্তরে ইন্টারনেটের মূল্য কমাচ্ছেন। ব্যবহারকারীরা এতে কীভাবে উপকৃত হবেন?
সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার; ফাইবার অ্যাট হোম তার সঙ্গে শরিক হলো। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমাদের ব্যবসা না বরং ইন্টারনেট যে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে যাবে, সেটি প্রদান করাই আমাদের দায়িত্ব।
এজন্যই ফাইবার অ্যাট হোম আইটিসি পর্যায়ে ১০ শতাংশ, আইআইজি পর্যায়ে ১০ শতাংশ এবং এনটিটিএন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূল্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে গ্রাহকদের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে এমএনও বা আইএসপিদের খরচ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হবে। তারা যদি এই সাশ্রয় গ্রাহকদের অফার করে, তাহলে সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা খুবই উপকৃত হবে।
সম্প্রতি ফয়েজ তৈয়্যব বাংলাদেশের ইন্টারনেটের মানের কড়া সমালোচনা করেছেন। ইন্টারনেটের মান উন্নয়নে ফাইবার অ্যাট হোম কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
শীর্ষ পর্যায়ের ব্র্যান্ডের এবং ইউরোপীয় মানদণ্ডের প্রযুক্তি পণ্য দিয়ে দেশের ইন্টারনেট সঞ্চালনের রাস্তা তৈরি করেছে ফাইবার অ্যাট হোম। আমাদের আপ-টাইম ৯৯ দশমিক নয় এক (৯৯.৯১%) শতাংশ। আগামীতে যে প্রযুক্তিই আসুক না কেন, তার সঙ্গে আমাদের নেটওয়ার্ক ‘কম্প্যাটিবল’। ২০১৫ সালে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৬০০ টাকা, আজ সেটি মাত্র ২৮ টাকা। এটা সম্ভব হয়েছে এনটিটিএনদের জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ সরবরাহকারী এই রাস্তায় আসছেন না।
বিনা লাইসেন্সের প্রতিষ্ঠানগুলো যত্রতত্র ফাইবার বসাচ্ছে, আবার অনেক জায়গায় ফাইবার নেই। ফাইবার নেই বলতে বোঝাচ্ছি, এমএনও বা আইএসপিদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত এনটিটিএন অপারেটরদের থেকে সেবা না নেওয়ার প্রবণতাকে। এমএনওরা গড়ে মাত্র ১৫ শতাংশ ফাইবার প্রাইভেট এনটিটিএন থেকে নিয়েছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেটের মান আরও ভালো হতে পারত, কল ড্রপের মতো ভোগান্তিতে গ্রাহকেরা কম পড়তেন যদি এমএনওরা আরও বেশি এনটিটিএন এর সঙ্গে যুক্ত হতো।
ফাইবার অ্যাট হোমের আগামীর পরিকল্পনা কী?
টেলিকম ইকোসিস্টেমে ফাইবার অ্যাট হোম একটা অংশ। আমরা গ্রাহকদেরকে শুধু গ্রাহক মনে করি না বরং পার্টনার মনে করি কারণ আমরা সবাই টেলিকমের ছোট ছোট অংশ। আবার সবাই মিলেই টেলিকম খাত। সবার সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে মানসম্পন্ন সেবা দিয়ে যাব। তবে টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো ‘গ্রে লাইন’ চাই না। গ্রে লাইনের অনুপস্থিতি সবার জন্য উপকারী, ইতিবাচক এবং সম্ভাবনাময়।
বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের সঙ্গে ফাইবার অ্যাট হোম কী ধরনের কৌশল নিয়ে কাজ করতে পারে?
বিগত ১৫ বছরে যা পাইনি, সেটা এই সরকারের কাছে চাই। সেটা হচ্ছে পলিসি সাপোর্ট বা নীতিগত সহায়তা। যে উদ্দেশ্যে আগের সরকার আমাদেরকে লাইসেন্স দিয়েছিল, সেটা লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো করেছে। বর্তমান সরকারের চিন্তা হলো মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সুলভ মূল্যে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমরা সরকারের এই লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে সাধারণ জনগণকে সেবা দিতে চাই।
আপনার মতামত লিখুন :