সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৯:৫৮ এএম

অনিয়মে ব্যবস্থার নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৫, ০৯:৫৮ এএম

অনিয়মে ব্যবস্থার নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সরকারি অনুমোদন ছাড়া বছরের পর বছর চিকিৎসা দিয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। গত ২৭ নভেম্বর জাতীয় দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ পত্রিকায় ‘অনুমোদন ছাড়াই চলছে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল’ শিরোণামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের আদেশে এরই মধ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রূপালী বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ছায়ালিপি সংযুক্ত করে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল এবং বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালককে (স্বাস্থ্য) নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মঈনুল আহসান। স্মারক নং-স্বাঅধিঃ/হাসঃ/মন্ত্রণালয় বিবিধ-২/২০২৫/ ১২২।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশে বলা হয়, সংযুক্ত পত্রের মর্মানুযায়ী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অনুমোদন ছাড়াই চলছে ডায়াবেটিক হাসপাতাল’ (চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল) অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের আদেশ পাওয়ার পর গত ৬ মার্চ ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করে আদেশ জারি করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়। স্মারক নংম্বর বিঃপঃ স্বাঃচঃ/ বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান/পরিদর্শন/প্রশা-২০২৫/৩৮৪২।

কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), চট্টগ্রাম ডা. অং সুই প্রু মারমা নিজেই, সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিভিল সার্জন, চট্টগ্রাম ডা. জাহাঙ্গীর আলম এবং সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ারকে।

আদেশে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অনুমোদন ছাড়াই চলছে ডায়াবেটিক হাসপাতাল’ (চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল) অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারক নং- স্বাঃঅধিঃ/হাসঃ/মন্ত্রণালয় বিবিধ-২/২০২৫/১২২, তারিখঃ- ০৩/০২/২০২৫ মূলে নিম্ন স্বাক্ষরকারীকে অনুরোধ করা হয়। ওই সংবাদের বিষয়ে তদন্তের জন্য নিম্ন স্বাক্ষরকারীর সভাপতিত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।

গঠিত কমিটি আগামী ১৬ মার্চ বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালে গমন করে তদন্তকাজ সম্পাদন করবে। তদন্ত চলাকালীন প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এ বিষয়ে কমিটির সদস্যসচিব চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো বেসরকারি হাসপাতাল চালানোর সুযোগ নেই। অনুমোদনবিহীন সব হাসপাতালের বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নেব। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি আমরা।’ 

উল্লেখ্য, রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের হাতে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নথি থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের পক্ষে সর্বশেষ লাইসেন্স ইস্যু করেন মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য), যার সর্বশেষ মেয়াদ ছিল ৩০ জুন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এরপর থেকে কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই বিগত ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা করে আসছেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাহী কমিটির তৎকালীন সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনুমোদন না থাকলেও ডায়াবেটিক চিকিৎসার পাশাপাশি এই হাসপাতালে করা হয় সার্জারি, দেওয়া হয় অ্যানেস্থেসিয়াও। মুমূর্ষু রোগীর জন্য রয়েছে এইচডিইউ, সিসিইউ, এসডিইউ, আইসিইউ। কিডনি রোগীকে দেওয়া হয় ডায়ালাইসিস। জেনারেল বেড ও কেবিনসহ দেড়শ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন অর্ধশত। প্রতিদিন শত শত রোগী আসেন, ভর্তি হন হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা হতভাগা রোগীরাও জানেন না, যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই হাসপাতাল বহু বছর ধরে সরকারি খাতায় ‘অবৈধ’! 
অনুমোদন না থাকলেও নিয়মিত সরকারি অনুদান পায় এই হাসপাতাল। পূর্বে প্রতিবছর ১ কোটি টাকা অনুদান পেলেও ২০১৮ সাল থেকে অনুদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটিতে। যদিও বছর শেষে এই অর্থের বেশির ভাগই চলে যায় দুর্নীতিবাজ পর্ষদ মেম্বারদের পকেটে। শুধু তাই নয়, ‘চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি’ নামে যে সংগঠনের সামাজিক অনুদানের অর্থায়নে পরিচালিত হয় এই হাসপাতাল, গত সাত বছর সমাজসেবা অধিদপ্তরের নথিপত্রে এই সংগঠনও অবৈধ! দীর্ঘ অনুসন্ধান, সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে রূপালী বাংলাদেশে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন এই প্রতিবেদক।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ডায়াবেটিক রোগীদের সেবা দিতে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের লাইসেন্স নম্বর ৩৬৫৪। তবে কত সালে এই লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালে এনালগ পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করে ২০১৭ সাল থেকে ডিজিটালাইজড লাইসেন্স পদ্ধতি চালু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সে প্রক্রিয়ায় নতুন করে লাইসেন্স নেয়নি চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। বছরের পর বছর অবৈধভাবে এই হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সিভিল সার্জন কার্যালয়। ২০১৭ সালের পর চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল নতুন করে লাইসেন্স নেয়নি বলে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছিলেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অফিস সহকারী মো. শাহেদ।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালকে ‘অবৈধ’ হাসপাতাল বলে রূপালী বাংলাদেশের কাছে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেছিলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি নামে যে ‘সমিতি’র ব্যানারে পরিচালিত হচ্ছে এই হাসপাতাল, ২০১৮ সালের পর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সেই সংগঠনের কোনো অনুমোদন নেয়নি পরিচালানা পর্ষদ। যে কারণে ২০১৮ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি অবৈধ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফরিদুল আলম।

তিনি জানান, ১৯৭৮ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে নিবন্ধন নেয় ‘চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি’, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর সি-৬৯৫/৭৮। ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিস আদেশ স্মারক নম্বর ৪১.০১.০০০০.০৪৬.২৭.০২৫.২২.১০০ মূলে সংস্থার তৎকালীন কমিটিকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর বিধান মোতাবেক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। কাজেই সংস্থার অনুমোদিত কার্যকরী কমিটির সাধারণ সভা আহ্বান ও নির্বাচন আয়োজনের বৈধতা নেই।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সরকারের অনুমোদন না থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি বছর ২ কোটি টাকা অনুদান পায় এই হাসপাতাল। কিন্তু অনুদানের সেই অর্থ হাসপাতালের রোগীদের জন্য ব্যয় না করে অর্থ চলে যায় ব্যক্তিগত তহবিলে। সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এরই মধ্যে প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে হাবিবা গত ৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বরাবর আত্মসাৎকৃত সরকারি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য একটি পত্র পাঠান, যার স্মারক নং ৪৫.০০.০০০০.৭২.২৭.০০১.২১-৯৭।

উক্ত পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল তসরুপসহ স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ‘সতেরো লক্ষ পঞ্চাশ হাজার’ এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ‘দশ লক্ষ’ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে মর্মে মতামত প্রদান করা হয়। আত্মসাৎ করা অর্থ ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা প্রদানের আদেশ দেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

আরবি/জেডআর

Link copied!