ফারুক আহমেদ, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ২ মে, ২০২৪, ০৬:২৮ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

ময়মনসিংহে

২০০ বছরেও ‘স্বাদ বদলায়নি’ মুক্তাগাছার মন্ডার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘দূর থেকে ময়মনসিংহে কেউ বেড়াতে এলে আমাদের আসল মন্ডার স্বাদ পেতে মুক্তাগাছার মন্ডার দোকানে চলে আসেন। আমরা এখনও মন্ডার আগের স্বাদ ধরে রাখায় ক্রেতার কমতি নেই।’ ‘মন্ডার’ নামটি মুখে আসলেই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডার নাম চলে আসে। সারা দেশে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে মন্ডা পাওয়া গেলেও এখানকার মন্ডার স্বাদের কথাই সবাই বলে। ১৮২৪ সাল থেকে এই সুনাম ধরে রেখেছে এখানকার কারিগররা। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল। তার প্রতিষ্ঠিত মন্ডার দোকানে প্রায় ২০০ বছর ধরে মন্ডা তৈরির ব্যবসা চলছে বংশানুক্রমে। এখন পঞ্চম পুরুষের ব্যবসা। তবে মন্ডার প্রসারের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মুক্তাগাছার জমিদারেরা। মুক্তাগাছা পৌর শহরে জমিদারবাড়ীর কাছে পূর্বদিকে রাম গোপাল পাল বা গোপাল পালের মন্ডার দোকান।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর ক্রেতা আসছেন মন্ডা কিনতে। কয়েকজন দোকানের ভেতরে বেঞ্চে বসে মন্ডা খাচ্ছেন। কেউ আবার মন্ডা প্যাকেট করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ক্রেতাদের আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিক্রেতারা। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন আবুল হাসেমসহ তার পাঁচ সদস্যের পরিবার। আসল মন্ডার স্বাদ পেতে তিনি চলে আসেন মুক্তাগাছায়। মন্ডা কেনার সময় কথা হয় তার সঙ্গে। আবুল হাসেম বলেন, ‘ময়মনসিংহে যখনই আসি, মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়ে তৃপ্তি পাই। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মন্ডা পাওয়া গেলেও এই মন্ডার স্বাদের সঙ্গে মেলে না। ফলে সপরিবারে মন্ডা খেয়ে ৬০০ টাকা কেজি দরে ৩ কেজি কিনে বাসায় নিচ্ছি।’

মন্ডার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মুক্তাগাছা পৌর এলাকার বয়োবৃদ্ধ জমশের আলী। মন্ডা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তাগাছা উপজেলা সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছে এই মন্ডার কারণে। ঐতিহ্যবাহী এই মন্ডা একচেটিয়া বিক্রি হয়। ফলে উপজেলাজুড়ে কমপক্ষে ছয় থেকে সাতটি মন্ডার দোকান গড়ে উঠেছে। তবুও দূর থেকে আসা ক্রেতারা খুঁজে খুঁজে পুরাতন এই দোকানেই চলে আসেন।’

জনশ্রুতি আছে, গোপাল পাল স্বপ্নে প্রায়ই এক সাধুর দেখা পেতেন। স্বপ্নে সাধু তাকে মন্ডা তৈরির নিয়ম শেখাতেন। প্রায় রাতেই সাধু মন্ডা তৈরির নিয়ম বলতেন। সর্বশেষ এক রাতে মন্ডা তৈরির শেষ নিয়মটি শেখালেন এবং বললেন, ‘তুই এই মন্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোর মন্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। ’গোপাল পাল স্বপ্নে মন্ডা তৈরির পদ্ধতি পেয়ে মন্ডা বানিয়ে প্রথমেই খাওয়ান মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। মন্ডা খেয়ে তৃপ্তি পেয়ে নিয়মিত মন্ডা দিতে বলেন। মহারাজা সূর্যকান্তের ছেলে শশীকান্তও মন্ডা খুব পছন্দ করতেন। সেই থেকে আজ অবধি বংশপরম্পরায় মন্ডা তৈরি হচ্ছে।

দোকানে থাকা একটি পুস্তিকা থেকে জানা যায়, মন্ডার কারিগর গোপাল পাল ১৭৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস মুর্শিদাবাদে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মুর্শিদাবাদের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তখন গোপাল পালের বাবা রাম পাল প্রাণভয়ে পালিয়ে মালদহ হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে চলে আসেন। এরপর সেখান থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে নতুন করে বসবাস শুরু করেন।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গোপাল পালের বংশধররা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানেও তারা মন্ডা তৈরি করেন। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া বাংলাদেশের মন্ডার বিশেষ উপযোগী ছিল না। তাই আগের স্বাদ আর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তাগাছায় ফিরে এসে সেই একই স্থানে মন্ডা তৈরি আরম্ভ করেন তারা। ১০৮ বছর পর ১৯০৭ সালে মারা যান সুস্বাদু এই মন্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল। পাকিস্তান আমলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দোকানে বসে মন্ডা খেয়ে সুনাম করেছেন।


মন্ডা বিক্রির ফাঁকে কথা হয় দোকানের ম্যানেজার আশিষ দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি দুই বছর যাবৎ এই মন্ডার দোকানে চাকরি করি। করোনার সময় কিছুদিন দোকান বন্ধ ছিল। তখনও মন্ডার স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ক্রেতা দোকানে এসে ফোন দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায় এই মন্ডার জনপ্রিয়তা কত।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ক্রেতারা এসে মন্ডা খাওয়ার পাশাপাশি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মন্ডা বিক্রি করতে সারা বছর ব্যস্ত সময় পার করি।’ গোপাল পালের দোকানটি পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্র নাথ পালের মৃত্যুর পর পরিচালনা করছেন রমেন্দর
ছোট ভাই রবীন্দ্র নাথ পাল, রথীন্দ্র নাথ পাল, শিশির কুমার পাল ও মহির কুমার পাল।

গোপাল পালের বংশধর রবীন্দ্র নাথ পাল বলেন, ‘বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, ইফতার পার্টিসহ যেকোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের মন্ডা একচেটিয়া বিক্রি হয়। বাংলাদেশের কোথাও আমাদের কোনো শাখা, এজেন্ট, শোরুম, বিক্রয়কেন্দ্র বা বিক্রয় প্রতিনিধি নেই। দূর থেকে ময়মনসিংহে কেউ বেড়াতে এলে আমাদের আসল মন্ডার স্বাদ পেতে এই দোকানে চলে আসেন। আমরা এখনও মন্ডার আগের স্বাদ ধরে রাখায় ক্রেতার কমতি নেই।

তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি মন্ডার দাম ৬০০ টাকা। প্রতি কেজিতে ২০টি মন্ডা পাওয়া যায়। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে মন্ডা তৈরি হয়। তবে ব্যবসার স্বার্থে মন্ডা তৈরির কৌশল কাউকেই বলা হয় না। আমাদের বংশপরম্পরায় এই মন্ডার প্রাচীন স্বাদ বজায় থাকবে যুগ যুগ ধরে।’

মন্তব্য করুন