রাবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৪ জুলাই, ২০২৪, ০৪:৩৮ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

কোটা ও পেনশন স্কিম

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল রাবি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রত্যয় পেনশন স্কিম প্রত্যাহার ও সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আন্দোলনে উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বেলা ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে জড় হতে থাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে তারা টানা বৃষ্টির মধ্যে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন। এদিকে বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের প্রধান ফটকে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাহার এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষকেরা। একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারাও।

সরেজমিনে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেলা ১০ টার দিকে দল বেধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে উপস্থিত হতে থাকেন। এরপরে মিছিল নিয়ে তারা প্যারিস রোড থেকে মেইন গেটের দিকে অগ্রসর হন। পরে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। পরে দুপুর ১২ টার দিকে তারা মেইন গেট থেকে মহাসড়ক ধরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কাজলা গেটের দিকে অগ্রসর হন এবং বেলা পৌনে ১ টায় আবার প্যারিস রোডে এসে আগামীকাল (৫ জুলাই) নতুন কর্মসূচির ডাক দিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তবে এসময় কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।

আন্দোলন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আজিজুর রহমান বলেন, দেশের কোটা প্রথায় উপযোগী জনসংখ্যার সংখ্যা ১ শতাংশের কম কিন্তু তাদের জন্য কোটা ৫৬ শতাংশ। এমনিতেই দেশের চাকরির বাজার প্রতিযোগিতাপুর্ন। সেখানে কোটায় অধিকাংশ সিট চলে গেলে আমাদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দাবি ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত এসেছিল তা পুনর্বহাল থাকুক।

আন্দোলনে উপস্থিত আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি বলেন, আমরা মেয়েরা মনে করি আমরা পিছিয়ে পড়া জাতি না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যাবহারকারীরাও যে পিছিয়ে পড়া জাতি না আমরা এইটা জানি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সেই বৈষম্য দূর করতে চাইলে ৫৬ শতাংশ কোটা রাখার মানে হয় না। আমরা চাই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল করা হোক এবং অন্যান্য চাকরিতে তা পুনর্বিন্যাস করা হোক।

এ সময় কোটা পুনর্বিন্যাস ও নতুন নীতিমালা প্রদানের আহ্বান জানিয়ে পপুলেশন সায়েন্স এন্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আমানুল্লাহ খান বলেন, প্রথমত, ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার। দ্বিতীয়ত, ব্যাক্তি তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ একবার কোটা ব্যাবহার করতে পারবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তৃতীয়ত, প্রতি জনশুমারির সাথে অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যমান কোটার পুনর্মুল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিবেকের তাড়নায় এখানে উপস্থিত হয়েছি। এই রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো সমতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত রাখা। রাষ্ট্রের চোখে সকল নাগরিক সমান। এ বিষয়ে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করলে সেটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী যারা সংখ্যা গরিষ্ঠ তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। তারা রাষ্ট্রের জন্য যেটি কল্যাণকর মনে করবে সেটিই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি বঙ্গবন্ধু ৭২ সালে যে কোটা দিয়েছিলেন সেটা ছিল যুদ্ধরতদের জন্য, কারণ তারা পড়াশোনা করতে পারেন নি। তখন যারা বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা আহত হয়েছিলেন তাদের জন্য। তিনি সন্তান বা নাতি-নাতনীদের জন্য কোটা দেন নি। কিন্তু বর্তমানে নাতি-নাতনীরাই এটার সুবিধা নিচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটি আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। আজকে যেভাবে মেধাকে বঞ্চিত করে জাতিকে মেধা শূন্য করার ষড়যন্ত্র চলছে এভাবে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের প্রায় দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

এদিকে শিক্ষকদের কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ওমর ফারুক সরকার বলেন, আমাদের হিসাব বুঝিয়ে লাভ নাই। আমাদের আইন বুঝাইয়া লাভ নাই। রাতের অন্ধকারে প্রজ্ঞাপন দিবেন। আবার সেই প্রজ্ঞাপন সংশোধনও করবেন। তার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? এই প্রত্যয় স্কিমের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাতিত কেউ নিচ্ছে না। শুধু এই মন্ত্রণালয়ে যারা বসে আছেন তারাই কী সব? আমাদের কী বিশেষজ্ঞ কেউ নেই? আমাদের এর পরিবর্তে নতুন কিছু চিন্তা ভাবনা দরকার। আমাদের সাথে বসে কথা বলেন; কেন আমরা এটাকে যৌক্তিক দাবি বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণায় ও পড়াশোনায় থাকতে চাই। তাদেরকে রাস্তায় নামাবেন না।

এ কর্মসূচিতে রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি খুবই প্রশংসনীয় ও জনকল্যাণমুলক উদ্যোগ ছিল, কিন্তু যারা এর দায়িত্বে ছিল তারা সফলভাবে এই উদ্যোগকে বিতর্কিত করেছে। তবে আমরা প্রত্যয় স্কিম বাতিলের কথা বলছি না।  প্রত্যয় স্কিমে ৪০৩ ধরনের শ্রেণি রয়েছে। তারা যেহেতু কোনো আন্দোলন করছে না, সেহেতু আমরা তাদের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি,  এই প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম প্রত্যাহার করার জন্য। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের এ অবস্থান কর্মসূচিকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।  তবে তারা সফল হবেনা। আমরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ওমর ফারুক সরকারের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাংগুয়েজের ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

 

 

মন্তব্য করুন