কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৪ জুলাই, ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

কুড়িগ্রামে ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ধরলার পানিও। বাড়ছে অনান্য নদনদীর পানি। এতে নদনদী অববাহিকার চর ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে জেলার ৯ উপজেলার অন্তত ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেছেন। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম বাড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুড়িগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, অব্যাহত পানি বৃদ্ধি পেয়ে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) দুপুর ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৬৭ সেন্টিমিটার ও নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে এই নদের পানি উলিপুরের হাতিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৩  সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ধরলার পানিও কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। দুপুর ১২টায় এই নদী বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুধকুমার ও তিস্তার পানি কিছুটা কমে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। 

বানভাসি এসব পরিবারের বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই পরিবার নিয়ে উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই পরিবার নিয়ে নৌকা যোগে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজা। অনেকেই কোথাও যেতে না পেরে নৌকা কিংবা চৌকি উঁচু করে সেখানেই পরিবার নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। অনেকের চুলা তলিয়ে যাওয়ায় তাঁরা রান্না করে খেতে পারছেন না। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় তাঁরা বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন। অনেকের শৌচাগার তলিয়ে যাওয়ায় মলমূত্র ত্যাগ নিয়ে তাঁরাও রয়েছেন দূর্ভোগে। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার গ্রামীণ সড়ক। বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার্তরা নৌকা কিংবা কলাগাছের ভেলায় উঠে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করছেন। বন্যার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা। ফলে অনেকের মোবাইল ফোনে চার্জ না  থাকায় জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। এসব বানভাসী মানুষজন পরিবার নিয়ে অন্ধকারে পোকামাকড়ের আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পরেছেন বানভাসীরা।  তলিয়ে গেছে এসব এলাকার বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাস। ফলে গবাদি পশু গুলোকে নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় ভুগছেন। 

তলিয়ে গেছে শতশত বিঘার শাক-সবজি, পাট সহ মৌসুমি ফসলের খেত। প্লাবিত এসব এলাকার বাসিন্দারা নানা অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে নিয়ে দিন পার করছেন। 

ব্রহ্মপুত্রের পানি বেগতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দুইদিন আগে বসতবাড়িতে ঢুকেছে জেলা সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভগবতীপুরের কৃষক শাহালমের বাড়ীতে। গতকাল রাতেই তাঁর ঘরের চৌকি অব্দি পানি উঠেছে। এতে পরিবার আশ্রয়স্থল নিয়ে বিপাকে পরেছেন তিনি।

শাহালম বলেন, 'দ্যাখতে দ্যাখতে চোখের সামনেই বাড়িঘর বানের পানিত তলে গেলো! থাকার জায়গাটুকুও শ্যাষ। তাই বউ ও বাচ্চাদেরকে শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে রাখতে যাচ্ছি! জানিনা এই বান এই কয়দিন থাকবে! 

ব্রহ্মপুত্রের পানির তেড়ে ভেসে গেছে একই এলাকার কৃষক মাইদুলের ৪০ মন ধান। তলিয়ে গেছে বসতবাড়ী। এখন পরিবারকে নিয়ে নৌকায় বসবাস করছেন। চুলা তলিয়ে যাওয়ায় রান্না করে খেতে পারছিনা।'

জেলা সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, 'আমার ইউনিয়নের অন্তত হাজার পরিবারের বসতবাড়ি পানিতে তলিয়েছে। এতে করে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ বন্যায় চরম দূর্ভোগে রয়েছে। গতকাল ইউএনও স্যার সহ বানভাসী ১০০ পরিবারের মাঝে চাল, ডাল ও তেল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি প্রশাসনকে অবগত করা হচ্ছে।' 

নাগেশ্বরী উপজেলার নুনুখাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আমিনুল ইসলাম বলেন, 'ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে আমার ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর, মাঝের চর, ফকিরগঞ্জ সহ চর কাপনা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনুমানিক ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। 

উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালাডোবা, বতুয়াতলি মূসার চর, ব্যাপারিপাড়া নতুন চর এবং পূর্ব ও পশ্চিম মশালের চরের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বাধ্য হয়ে এসব পরিবারের অনেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। বসতভিটা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকাতেই রান্না ও খাবার সেরে নিচ্ছেন। তবে শৌচাগার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষজন। বতুয়াতলি মূসার চরের বাসিন্দা শরিফুল বলেন, ‘আমাদের গ্রামে ৪০ টিরও বেশি পরিবারের বসবাস। সবকটি পরিবারের ঘরের ভেতর পানি। বাইরে চারপাশে পানি। পানি বাড়তে আছে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা বিতরণ জোরদার করা হয়েছে। জেলায় মোট ৪০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং দুর্গতদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ইতোমধ্যে উপজেলাগুলোতে ১৭৬ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা উপবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী তা বিতরণ চলছে। নতুন করে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। শিগগির উপজেলাগুলোতে তা উপবরাদ্দ দেওয়া হবে। সরকার সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে দুর্গত মানুষদের পাশে থাকবে।’

মন্তব্য করুন