বাঙালির মেধা ও মননের মেলা, অমর একুশে বইমেলা ১০ দিন পার করবে আজ। অথচ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি মেলা। শেষ হয়নি সব স্টল নির্মাণের কাজ। মেলা শুরুর পরও দেখা মেলে হাতুড়ি-বাটালির ঠুকঠাক শব্দ। শুধু তাই নয়, মেলার মাঠে প্রবেশ করলে মনে হয় এটা কোনো সৃজনশীল মেলা নয়, সচরাচর মেলাগুলোর একটি। কারণ মেলার মাঠে চানাচুর-বাদাম, চা, শসাসহ নানা পণ্য নিয়ে ঘুরছেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা।
রয়েছে ভিক্ষুকদের উৎপাতও। টিএসসির পাশের ফটকের সামনে থেকে মেলার মূল প্রাঙ্গণ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে দেখা যায়, বসছে হরেক পণ্যের পসরা। সেখানে তেলে ভাজা বেগুনি, পিঁয়াজু, মাশরুম-পাকোড়া থেকে শুরু করে কচি ডাবের পুডিং, ফুল, চুড়ি, ফিতা, ইমিটেশনের গয়না, ভিউকার্ড, কাপড়ের পুতুলসহ হরেক জিনিস। এতে বিরক্ত প্রকাশক ও মেলায় আগতরা।
যোদ্ধা প্রকাশনীর প্রকাশক বলেন, বইমেলার ভেতর এভাবে চলতে থাকলে বইমেলার যে নিজস্বতা তা হারিয়ে যাবে। মেলার ভেতর এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করি।
লেখক শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, বইমেলাতে লেখক হিসেবে আমরা পাঠকদের সমাগম হবে সেটিই আশা করি। তবে এবারের মেলায় দেখা যাচ্ছে, মেলার ৯ম দিনে এসেও কিছু স্টলের কাজ চলছে- এতে পাঠকদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করি।
তিনি বলেন, আমি একটু যুক্ত করতে চাই, এবারের বইমেলায় আমার নতুন বই এসেছে ‘বাংলা বসন্ত’। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা বাংলা বসন্ত বইটি প্রকাশ করছে অনুজ প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন সজিব জোয়াদ্দার। প্রকাশক আশরাফুল ইসলাম তুষার জানান, বাংলা বসন্ত বইটি মেলায় পাওয়া যাচ্ছে এশিয়া পাবলিকেশনসের ৫৬১-৫৬২-৫৬৩-৫৬৪নং স্টলে। বইটির মূল্য ৫২০ টাকা। স্টলের পাশাপাশি বইটি সব অনলাইন বুকশপ ও লেখকের পেজ থেকেও সংগ্রহ করা যাবে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা, আহত ও শহিদ আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা আমার এই উপন্যাসে পাঠক তার পছন্দের কোনো চরিত্রে ভর করে ঘুরে আসতে পারবেন আন্দোলনের সেই ভয়াবহ দিনগুলো থেকে। আমি পাঠকদের উদ্দেশে বলব, আপনারা বই পড়ুন, বই কিনুন এবং বই উপহার দিন।
বইমেলার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা জানিয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী অনুমা সৃষ্টি অনু। তিনি বলেন, একজন টিকটকার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে আমি অসম্মান করছি না। আমি এটাও বলতে চাই না, তারা বই লিখতে পারবে না।
তবে তাদের প্রতি অনুরোধ, তারা লেখার জন্য পড়াশোনা করুক। একই সাথে প্রকাশকদের প্রতি অনুরোধ, পাণ্ডুলিপি পড়ে বই ছাপান। আমরা যারা পাঠক, তাদের দায়ও সমান। আমাদের সচেতন হতে হবে। সো-কল সেলিব্রিটির বই কিনতে লাইন দেওয়া, তার সঙ্গে সেলফিবাজি করা, আর লেখক এক বিষয় নয়। যত দ্রুত পাঠক হিসেবে আমরা বুঝতে শিখব তত দ্রুত বাংলা সাহিত্য ধ্বংসের যে খেলা শুরু হয়েছে তা বন্ধ হবে।
আমরা দেখি, বর্তমানে লেখকের চেয়ে লেখিকারা বেশি অশ্লীল। আবার সেই অশ্লীল লেখার পাঠকও কিন্তু বেশ। যারা এমন অখাদ্য-কুখাদ্য লিখছেন তারা যে সবাই বয়সে তরুণ তা মোটেও নয়। তেমনিভাবে নোংরামিতে পরিপূর্ণ এসব বইয়ের কিছু পাঠক মধ্যবয়সিরাও বটে। মনে হয়, তাদের জীবনে অনেক কিছুর অভাব, ফলে ফ্যান্টাসিকে সঙ্গে নিয়ে কিছু সময় ভালো থাকার একটা চেষ্টা করেন।
আবার অখাদ্য-কুখাদ্য লেখা পাঠককে বিমুখ করে বেইমেলা থেকে। কারণ, বইমেলা মানেই তো নতুন নতুন বইয়ের আগমন। তবে পাঠকরা আসলেই যারা বই পড়েন তারা ভালো লেখা পড়তে চান। তারা যখন দেখেন, মেলা ঘুরে হুমাযূন আহমেদ স্যারসহ হাতে গোনা কয়েকজন পুরোনো লেখকের বই-ই পড়া যায়, তখন তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
মূল মঞ্চের আয়োজন
গতকাল ৯ম দিন মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ৯৭টি। রোববার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘মাকিদ হায়দারের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চঞ্চল আশরাফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আসিফ হায়দার এবং শাওন্তী হায়দার। সভাপতিত্ব করেন আতাহার খান।
প্রাবন্ধিক বলেন, কবি হিসেবে মাকিদ হায়দারের আত্মপ্রকাশ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তার নিকট-অতীত ও সমকালীন কবিদের রচনায় রোমান্টিক আবেগ প্রকাশের যে ধারা গড়ে উঠেছিল, তার অনুগামী না-হয়ে নিজস্ব পৃথক একটি ধারা গড়ে তোলার চেষ্টায় তিনি ব্যাপৃত থেকেছেন।
তিনি এমন এক বর্ণনারীতির চর্চা করেছেন, যা ষাটের দশকের কবিতায় খুব কমই দেখা যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরাভরণ কিন্তু অর্থবোধক সারল্যের অনুশীলন করেছেন তিনি। তার অধিকাংশ কবিতাই আখ্যানের প্রাথমিক উপাদান বা গল্পের প্রধান শর্তবৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত।
সভাপতির বক্তব্যে আতাহার খান বলেন, পারিবারিকভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা মাকিদ হায়দার তাঁর সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের থেকে ভিন্নমাত্রায় নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। আরোপিত রূপ বা আড়ালের আশ্রয় না নিয়ে স্পষ্ট এবং প্রচলিত ভাষায়ই তিনি কাব্য রচনা করেছেন। তার কবিতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যজগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।
সোমবারের অনুষ্ঠান
সোমবার ১০ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলার ১০ম দিন মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ : মনিরুজ্জামান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মাশরুর ইমতিয়াজ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন সালমা নাসরীন এবং মামুন অর রশীদ। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক মনসুর মুসা।