টিএসসির উল্টো পাশ ও বাংলা একাডেমির বিপরীত পাশের রমনা কালীমন্দিরের প্রবেশদ্বারসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশদ্বারে ছিল দর্শনার্থী ও বইপ্রেমীদের জটলা।
সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে একুশে বইমেলায় প্রবেশের এই দৃশ্য একুশের শাণিত চেতনার বইমেলাকে করে তুলেছিল প্রাণবন্ত।
তবে, একটা সময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই মুখরিত থাকত পুরো বইমেলা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা সম্প্রসারণের পর থেকে মূল প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বইয়ের পসরা মূলত সেখানেই বসে।
ফলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল ও প্যাভিলিয়ন।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তাদের স্টল নিয়ে বসেছে। সেখানেও আছে গুরুত্বপূর্ণ সব বই আর প্রকাশনা।
বরাবরের মতো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের মেলার অংশে তেমন একটা ভিড় দেখা যায়নি মেলার ১১তম দিনেও।
এদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নের সামনে ভিড়ের দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
অমর একুশে বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই রাখাকে কেন্দ্র করে ‘সব্যসাচী’ স্টলের সামনে উত্তেজনা ও হট্টগোলকে কেন্দ্র করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির সচিব ও বইমেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান সেলিম রেজা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘গতকালের ঘটনায় সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসব।’
বইমেলার বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর: বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বইমেলার বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন দেশের ১১৪ জন লেখক, শিল্পী ও অধিকারকর্মী।
গতকাল এক বিবৃতিতে তারা বলেন, গত সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পূর্ব হুমকি প্রদানের পর একটি দল সব্যসাচী নামক প্রকাশনীর স্টলে হামলা চালিয়েছে।
এই মব আক্রমণ মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এক গুরুতর আঘাত। সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রকাশককে লাঞ্ছিত করে স্টল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়ার যে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে এই মবগোষ্ঠী দেশের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী।
গতকালের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে বইমেলার বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর।
হামলার সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব আক্রমণকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে জানিয়ে তারা আরও বলেন, বইমেলার নিরাপত্তাব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে বহুগুণ জোরদার করতে হবে।
এ ধরনের সহিংস বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধে রাষ্ট্রের কোনো নতি স্বীকার না করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
যদি এই ন্যূনতম দাবিগুলোও পূরণ না করা হয়, তবে বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।
বিবৃতি দেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা, নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকার, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, মাসউদ ইমরান মান্নু, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মানজুর আল মতিন প্রমুখ।
নতুন বই: গতকাল মঙ্গলবার অমর একুশে বইমেলার ১১তম দিনে নতুন বই আসে ৯১টি। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আদর্শায়িত কল্পলোক ও শাহেদ আলীর দ্বিধাচিত্ত মন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিবলী আজাদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোস্তাক আহমাদ দীন।
সভাপতিত্ব করেন চঞ্চল কুমার বোস।
প্রাবন্ধিক বলেন, শাহেদ আলীর গল্পে যেমন দার্শনিক প্রতীতি রূপায়ণের চেষ্টা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সামাজিক বৈষম্য আর অনাচার ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস।
তার রচনাগুলো উত্তাল সময়, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধকালের বৌদ্ধিক ও নান্দনিক প্রতীতির প্রতি লেখকের একধরনের প্রতিক্রিয়া।
সমকালের অন্যান্য লেখকের মতো তিনি উচ্চকণ্ঠী নন। তার গল্পে নেই হুল্লোড় কিংবা মতাদর্শিক উচ্ছ্বাস। বিমূর্ত দার্শনিকতা ও সৌন্দর্য অনুসন্ধান শাহেদ আলীর লেখার গুরুত্বপূর্ণ এক বৈশিষ্ট্য।
তার গল্পে উঠে আসে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র প্রান্তিক চাষি এবং শহুরে মুটে-ভিখারি চরিত্রগুলো। শিল্পের দাবি অক্ষুণ্ন রাখার ক্ষেত্রে শাহেদ আলী যথেষ্ট সফল একজন লেখক।
আলোচক বলেন, রাজনীতিসচেতন সক্রিয় ব্যক্তিত্ব শাহেদ আলী সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
তবে তার রাজনৈতিক ও সৃষ্টিশীল জীবনকে কখনো একাত্ম করেননি। এমনকি তার গল্পের মধ্যে কঠোর নীতিবোধও আরোপ করেননি।
তার রচনায় জীবনবাস্তবতার যে চিত্র তিনি এঁকেছেন, সেখানে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতিই আমাদের চোখে পড়ে। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি লোকজ, আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দরাজিকে সাবলীলভাবে তার সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন।
সভাপতির বক্তব্যে চঞ্চল কুমার বোস বলেন, শাহেদ আলীর রচনায় বাংলার কৃষিভিত্তিক জীবনের ছন্দ, সুর, কথা ও উপকথা ধরা পড়ে। তার লেখার অনুষঙ্গ হলো সাধারণ বাঙালি ঘরের সাংস্কৃতিক উপকরণ।
তার বিস্তৃত সাহিত্যকর্ম নিবিড় পাঠ ও গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে।
আজকের অনুষ্ঠান : আজ বুধবার অমর একুশে বইমেলার ১২তম দিনে মেলা শুরু হবে বেলা ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাসান রোবায়েত।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মঈন জালাল চৌধুরী ও আশফাক নিপুণ। সভাপতিত্ব করবেন ফরহাদ মজহার।
আপনার মতামত লিখুন :