ঢাকা: চড়া দামে কিনে সরকারনির্ধারিত কম দামে বিক্রি করতে না পারায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম ১৮০ টাকা ও সাদা ডিম ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বকশিরহাটে সাদা ডিম ডজন ১৬৫ টাকা ও বাদামি ডিম ১৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত কিছুদিন ধরেই ডিমের বাজারে দাম নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। দেশে আমদানির পরও এবার ডিম বিক্রি বন্ধ রাখায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঢাকার বাজারে ১২ থেকে ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে কিনে পাইকারিতে ডিম বিক্রি হয় প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আর খুচরা বাজারে সরকারিভাবে প্রতিটির দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের নিয়ম না মানলে জরিমানা ও শাস্তি হতে পারে, তাই বিক্রি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে, চট্টগ্রামেও সরকারি দামে ডিম কিনতে না পারা, রসিদ না দেওয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জরিমানার ভয়ে বিক্রি বন্ধ রেখেছেন কিছু আড়তদার। গতকাল সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন পাহাড়তলী ডিমের আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল শুক্কর লিটন।
এদিকে, তেজগাঁও আড়তে গত রোববার রাতে ডিমের কোনো ট্রাক আসেনি। শনিবার রাতেও খুব কম পরিমাণে ডিম বিক্রি করেছেন আড়তের বিক্রেতারা। গতকাল সোমবার থেকে তারা বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। যদিও ফার্মের মুরগির ডিমের বাড়তি দামের মধ্যে বাজারে ডিম সরবরাহে সমস্যা শুরু হয়েছে। তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে তাদের ডিম কিনতে হচ্ছে। কিন্তু কেনা দামের ভিত্তিতে তা বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারনির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। তাই ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান ও জরিমানার ভয়ে তারা মুরগির ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। ফলে রোববার রাতে তেজগাঁওয়ে ডিমের কোনো গাড়ি আসেনি; কোনো ডিম বিক্রিও হয়নি।
রাজধানীতে ডিম বিক্রির অন্যতম বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে তেজগাঁও আড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের খামার থেকে ট্রাকে করে এখানে ডিম আসে। এরপর তেজগাঁও থেকে ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজার ও পাড়া-মহল্লায় ডিম সরবরাহ হয়। ফলে তেজগাঁওয়ে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখলে সাধারণত খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ে।
রাজধানীর কয়েকটি খুচরা বাজারে গতকাল সোমবার জানা গেছে, এসব বাজারে ফার্মের মুরগির এক ডজন বাদামি ডিম ১৮০ টাকা এবং সাদা ডিম ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের সরবরাহ তুলনামূলক কম বলেও জানান বিক্রেতারা। ডিমের পাশাপাশি ফার্মের মুরগির দামও চড়া। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০Ñ২০০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ২৮০Ñ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর হাইব্রিড ধরনের সোনালি মুরগির দাম এখন ২৬০-২৭০ টাকা কেজি।
কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের কোনো দোকানে ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে না। শুধু একটি দোকানে কয়েকটি লাল ও দুই ডজনের মতো সাদা রঙের ডিম পাওয়া গেছে। এসব ডিমের ডজন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। যদিও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই লাল ডিমগুলো বিক্রি হয়ে যায়। দোকানের ডিম বিক্রেতা ফজুলল হক বলেন, ফার্মের মুরগির যে ডিম দেখছেন, তা গতকালের। তা-ও কাঁঠালবাগান বাজার থেকে আনা হয়েছে। তেজগাঁও ডিমের আড়ত থেকে গত দুই দিনে কোনো ডিম কিনতে পারিনি। এর মধ্যে গত রাতে সেখানে ডিম বিক্রি বন্ধ ছিল; আর তার আগের রাতে সরবরাহ ছিল খুবই কম।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন অনেক ব্যবসায়ী। সরকারি দামে ডিম কিনতে না পারা, রসিদ না দেওয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জরিমানার ভয়ে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন কিছু আড়তদার।
ডিম বিক্রি সম্পর্কে পাহাড়তলী ডিম আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল শুক্কর লিটন বলেন, গতকাল আমাদের ডিম কিনতে হয়েছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা দরে। আর সরকারনির্ধারিত দাম ১১ টাকা ০১ পয়সা। এ ছাড়া যাদের কাছ থেকে ডিম কিনছি, তারা রসিদ দিচ্ছে না। হয়রানি থেকে বাঁচতে আজ (গতকাল) থেকে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছি। সরকারি দামে কিনতে পারলে তখন আড়তে ডিম বেচব। আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ থাকলেও খুচরা বিক্রেতারা এখনো ডিম বিক্রি করছেন। চট্টগ্রামের বকশিরহাটে সাদা ডিম ডজন ১৬৫ টাকা, বাদামি ডিম ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়।
ঢাকার বাজারে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে তা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হয় ১৪২ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে এখন ১৭০-১৮০ টাকায় ডিম বিক্রি হচ্ছে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ জানান, সরকার খুচরা পর্যায়ে ডিমের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনছেন তারা। এ কারণে বিক্রিও করতে হচ্ছে বাড়তি দামে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গতকাল রাতে তারা পাইকারিতে ডিম বিক্রি করেছেন প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এই ডিম তারা কিনেছেন ১২ টাকা থেকে ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে।
আমানত উল্লাহ আরও জানান, তেজগাঁওয়ে দৈনিক ১৪-১৫ লাখ ডিম আসে। ঢাকায় ডিমের চাহিদা ১ কোটি। তেজগাঁওয়ের বাইরে কিছু জায়গায় অনেকে ঠিকই উচ্চ দামে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা।
ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘সরকারের নিয়ম না মানলে জরিমানা ও শাস্তি হতে পারে। তাই এখন বিক্রি বন্ধ রেখে কী করা যায়, সে উপায় খুঁজছি। আজকে (সোমবার) সকালে ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেখানে সভা থাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। বিকেলে আবার কথা বলতে যাব।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছিল। সরকারনির্ধারিত এই দাম বাস্তবায়ন করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে। মূলত অভিযানের ভয়েই ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ও তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা।
আপনার মতামত লিখুন :