- "সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দিনের আমলে ২০০৫ সালের জুনে লাইসেন্স পায় এয়ার কোম্পানিটি। ২০০৭ সালের ১০ জুলাই একটি বিমান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এর ঠিক ৮ মাস পর ২০০৮ সালে আরো একটি বিমান আনে এবং পর্যায়ক্রমে ১০টি বিমান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে ইউনাইটেড এয়ার"
‘সরকারের কিছু লোকের অসহযোগিতার কারণে ২০১৬ সালের মে মাসে ইউনাইটেড এয়ারের অপারেশন (উড্ডয়ন) বন্ধ হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের নানামুখী অসহযোগিতার কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। আমিও বৈষম্যের শিকার। ২০১৬ সালের পর থেকে চালু না করায় এয়ারগুলো এখন ব্যবহার অনুযোগী হতে চলেছে। এগুলো দেশের সম্পদ, রক্ষার দায়িত্ব সরকার এবং বিনিয়োগকারীদের। তবে নতুনভাবে উড্ডয়ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতা চাই।’
লন্ডন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে শুক্রবার রাতে (৯ আগস্ট) এসব কথা বলেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি)
লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। বৈষম্যবিরোধী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নতুন করে বিমানের ডানা মেলতে সহায়তার দাবি জানান তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দিনের আমলে ২০০৫ সালের জুনে লাইসেন্স পায় এয়ার কোম্পানিটি। ২০০৭ সালের ১০ জুলাই একটি বিমান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এর ঠিক ৮ মাস পর ২০০৮ সালে আরো একটি বিমান আনে এবং পর্যায়ক্রমে ১০টি বিমান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে ইউনাইটেড এয়ার।
ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই ছিল অসহযোগিতামূলক আচরণ। তার মন্ত্রিসভার সদস্য থেকে শুরু করে বিএসইসির অনেকের কাছে গিয়েছিলাম। নীতি সহায়তা দিতে তাদের অনুরোধ করেছিলাম। তারা কেউ আমার কথাগুলো বুঝতে চায়নি। কিন্তু কেন চায়নি, তা এখন বুঝেছি।’
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমার প্রতি নানা অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করা হয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ। সেই পরিচালনা পর্ষদে আমাকে রাখা হয়নি। যদিও নীতিমালা অনুসারে উদ্যোক্তা হিসেবে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছি।’
বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম।
বৈষম্যবিরোধী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টা পরিষদকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ইউনাইটেড এয়ারের ১০টি বিমান দেশের সম্পদ। বিগত সরকারের অমার্জনীয় কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেকে টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমি দেশের সম্পদগুলো ব্যবহার করে কিছু কর্মস্থল বৃদ্ধি ও রাজস্ব এনে দিতে চাই। এজন্য চাই সরকারের নীতি সহযোগিতা; যা বিগত সরকার করেনি।’
তিনি বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি- হাজার কোটি টাকার সম্পদ এয়ারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তারা (নতুন পর্ষদ) বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাই বিনিয়োগকারী এবং নতুন সরকারকে এটি রক্ষার অনুরোধ জানাই। এগুলো দেশের সম্পদ।’
ইউনাইটেড এয়ারের ২০০৭ সালে অপারেশন শুরু করে বিশ্বের ২৩টি দেশে নিজস্ব নামে চলে। এরপরে ২০১০ সালে স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্তির পরে ২০১২ সালে বিএসইসি নির্দেশনা দেয়- কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩০ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তাদের ধারণ করতে হবে এবং মূল উদ্যোক্তদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক। নতুন নির্দেশনার পরে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করতে না পারায় তারা সব শেয়ার বিক্রি করে দেন। সেই সময়ে উদ্যোক্তাদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের কুফল নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলে বৈঠক করেছি, মামলাও ঠুকেছি। কোনো কাজ হয়নি।’
‘সুদূরপ্রসারী এর প্রভাব কি পড়বে- তাদের বুঝিয়েও কোনো সুফল আসেনি; বরং ব্যর্থ হয়েছি। যার ফলাফল বর্তমান শেয়ার মার্কেট। এখন বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্য। দেশে দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন করেও বিনিয়োগ নেই’- বলেন তিনি।
‘এখন বুঝতে পারছি, সরকার এটা কেন করেছিল। কিছু লুটেরা গ্রুপ অব কোম্পানিকে অনৈতিকভাবে দেশের ব্যাংকগুলো লুট করতেই সুযোগ দিয়েছিল। যেমন- চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। দেশের বেসরকারি ৭টি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট ও পাচার করেছে- বিভিন্ন সংবাদপত্র এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যাংক এখন বিপর্যস্ত।’
‘২০১২ সালে নতুন কোম্পানি আইনে উদ্যোক্তাদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করে বিএসইসি। স্টক মার্কেট থেকে এসব ব্যাংকের ২ শতাংশ সাধারণ শেয়ার কিনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিজস্ব লোক বসায় লুটেরা গ্রুপগুলো। তারপরে বেনামি ঋণ নিয়ে শুরু করে টাকা পাচার।
’তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো এয়ার কোম্পানি ১০টি এয়ার বাস দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ বিমানেরও ১০টি এয়ার নেই; যা ইউনাইটেড এয়ারের ছিল। আর থাকাটাই ছিল হাসিনা সরকারে অসন্তোষের মূল কারণ। অন্যদিকে, আমি রাজনীতি বিমুখ মানুষ; যার শাস্তি হিসেবে বন্ধ হয়েছে এ কোম্পানি।’
‘এজিএমে পাস করে ৬২৪ কোটি টাকা উত্তোলনে বিএসইসি অনুমোদন দিলেও পরে আইসিবির অসহযোগিতার কারণে সব ভেস্তে গেছে’- বলেন তিনি।
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘উদ্যোক্তা হিসেবে আমার এখনও ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আমি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তবুও নানা অভিযোগ তুলে সম্মানহানি করছে। হেনস্তা করতে এমন অপকর্ম নাই তারা করছে না’ বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, তাদের দাবির মুখে হারমাইন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানকে অপারেশন চলাকালে এমডি বানানো হয়েছিল। (বর্তমানে এনআর ব্যাংকের চেয়ারম্যান) তিনি একদিনও চালাতে পারেননি। তিনিও তো এমডি ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বিএসইসির চেয়ারম্যান কোনো অভিযোগ তোলেননি। কেননা বিদেশে তার (মাহতাবুর রহমান) গাড়িতে করে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঘুরে বেড়ান; আমি তো সেই সুবিধা দিতে পারব না। তাকে যেই সুবিধা দিয়েছে, সেই সফল হয়েছে’ বলেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘নতুন পর্ষদের সময় অনেক পার হয়েছে, একটি বিমানও অপারেশনে নিতে পারেনি। পারবে কি করে- অভিজ্ঞতা থাকা চাই। এখন শেয়ার বিক্রি করে শুধুই বেতন নিচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছি- দেশের হাজার কোটি টাকার সম্পদ এসব এয়ারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাই বিনিয়োগকারী এবং নতুন সরকারকে এটি রক্ষার অনুরোধ জানাই।’
‘এখানে ১ লাখ ৬০ হাজার বিনিয়োগকারীর স্বার্থ আছে, তাদের স্বার্থে আমি সরকারের কাছে প্রার্থনা করছি- দেশের সম্পদ রক্ষায় সবার সহযোগিতা চাই। বিশেষত বৈষম্যবিরোধী এই সরকারের কাছে দাবি আমিও বৈষম্যের শিকার। তাই সবার সহযোগিতায় নতুন করে ইউনাইটেড এয়ার শুরু করতে চাই। দেশে নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে।’
‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চাই নীতি সহায়তা; যে শুদ্ধাচার নীতির ভেতর দিয়ে পরিচালিত হবে দেশের সব কোম্পানি’- বলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
বিএসইসি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউনাইটেডের নিজস্ব ১০টি উড়োজাহাজ দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একটি রয়েছে ভারতের রায়পুর বিমানবন্দরে, অন্যটি পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দরে।
বিএসইসি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারের কাছে বেবিচকসহ সরকারের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেবিচকের মূল পাওনা ৫৬ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ বাবদ পাওনা। ব্যাংকঋণ ও অন্য দেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছেও কয়েক শ কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে কোম্পানিটিকে চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল বিএসইসি; কিন্তু সেই উদ্যোগও এখন ভেস্তে গেছে। ফলে পর্ষদ পুনর্গঠনের উদ্যোগে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আশা তৈরি হয়েছিল, তাও অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :