ঢাকা সোমবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৪

ঝুঁকিতে দুই কোম্পানি, তেলেও ‘স্পন্দন’ জাগেনি

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৪, ১২:২৪ পিএম

ঝুঁকিতে দুই কোম্পানি, তেলেও ‘স্পন্দন’ জাগেনি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

►এমারেল্ড অয়েলের সম্পদ নিলামের ঝুঁকি
►ফুওয়াং ফুডসের চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার 
►ঋণের ১৪০ কোটি টাকা পরিশোধ হয়নি

ভোজ্যতেল হিসেবে রাইস ব্র্যান অয়েল ‘স্পন্দন’ ছিল পছন্দের শীর্ষে। চালের কুঁড়া থেকে তৈরি হওয়ায় এই তেলে মানুষের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। কোম্পানির মালিকানা দ্বন্দ্বে ৬ বছর আগে তেল উৎপাদন বন্ধ হয়। সেই তেল উৎপাদনের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে গত বছরে সরব ছিল এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ।

সবকিছুর মূলে ছিলেন জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি মেনোরি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাপান প্রবাসী মিয়া মামুন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ফুওয়াং ফুডস লিমিটেডের চেয়ারম্যান। প্রতারণায় মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এখন জেলহাজতে। তার সঙ্গে ছিলেন এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল হোসেন।

রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদনে গত বছরের জুনে যমুনা এডিবল অয়েলের সঙ্গে চুক্তি শেষে বছরে ৩০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করার তথ্য প্রকাশ করে এমারেল্ড অয়েল কর্তৃপক্ষ।

বলা হয়েছে, মেনোরি বাংলাদেশের আর্থিক জোগানে কোম্পানি পরিচালনা করবে এমারাল্ড অয়েল। জাপানে এক বছরে ৩ হাজার টন অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করা হবে। এতে নিট মুনাফা হবে ৩০ কোটি টাকা। সেই তেল উৎপাদন কাগজে-কলমে থাকলেও রপ্তানি এখনো হয়নি। উল্টো দুই কোম্পানি উৎপাদনমুখী করার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে শতকোটি টাকা কামিয়েছেন দুই উদ্যোক্তা।

সাবেক শিবলি কমিশনের কাছ থেকে এমারেল্ড অয়েলের ১৪০ কোটি টাকা ঋণের দায় গ্রহণ করে পরিবর্তিত এমারেল্ড অয়েল কর্তৃপক্ষ। বেসিক ব্যাংকের সেই ঋণ এখনো পরিশোধ হয়নি। শিবলি কমিশনের দায়িত্বে এমারেল্ড অয়েল ও ফুওয়াং ফুডস কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মালিকানা গ্রহণ করেন তারা। পরিবর্তিত সরকারের নতুন কমিশন সব অবগত হলেও এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ফুওয়াং ফুডস লিমিটেডের এমডি মিয়া মামুন গ্রেপ্তার সম্পর্কে তথ্য জানতে কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ জাইদুল ইসলামের কাছে ফোনে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক ব্যস্ত এবং পরে আপনাকে ফোন দেব।’ তবে আর ফোন দেননি জাইদুল।

এমারেল্ড অয়েল উৎপাদন ও দায় নিয়েছে জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি মেনোরি বাংলাদেশ। তার আরেক কর্ণধার ও এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল হোসেন। তাকে পরপর তিন দিন ফোন দেওয়া হয়। ফোনে না পেয়ে তার হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট করেও কোনো উত্তর আসেনি।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে গত বছরের ২৭ এগ্রিল জাপানের টোকিওতে রোড শো করে শিবলী কমিশন। সে সময়ে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি মেনোরি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুনের সঙ্গে শিবলী কমিশনের পরিচয়। মিয়া মামুন বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে দেশে আসতে বলেন। এরপর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বন্ধ থাকা দুটি কোম্পানির মালিকায় তাদের নিয়ে আসেন এবং নিয়ন্ত্রণেও সহযোগিতা করেন।

২০২৩ সালের ২০ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মূলে ছিলেন জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি মেনোরি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন। একই সঙ্গে ফুওয়াং ফুডস লিমিটেডের বর্তমান চেয়ারম্যান। এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল হোসেন মিলে দুটি কোম্পানির দখলে নেন।

দায়িত্ব পেয়েই অয়েল কোম্পানি উৎপাদনে ফেরার ঘোষণা দেন তারা। যদিও একই সময়ে ঝুলছিল কোম্পানির সম্পত্তি নিলামের আদেশ, অন্যদিকে উৎপাদন ও রপ্তানি শেষে বছরে ৩০ কোটি টাকা নিট মুনাফার ঘোষণা। দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকা দুটি কোম্পানির উৎপাদনে ফেরার তথ্যে শেয়ারপ্রতি দর আকাশ চূড়ায় উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি শিবলি কমিশন।

ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোম্পানির স্থাপনা এবং কারখানাসহ ৭৩২ শতাংশ জমি বন্ধক রাখে সাবেক পরিচালনা পর্ষদ। বেসিক ব্যাংকের আরোপিত ও অনারোপিত সুদসহ (গত বছরের হিসাব) মোট ১৪০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ। ঋণের দায়ে সম্পদ নিলাম গত বছরের ২৫ জুলাই দ্বিতীয়বার বিজ্ঞপ্তি দেন আদালত। তবে অদৃশ্য কারণে দু’বারই নিলাম হয়নি। যা এখনো ঝুলন্ত রয়েছে। এরই মধ্যে দুই কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দিয়ে শতকোটি টাকা কামিয়েছেন জাপানি দুই উদ্যোক্তা। সম্পদ নিলামের ঝুঁকি নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে চলছে এমারেল্ড অয়েল কোম্পানি।

অন্যদিকে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি মেনোরি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুনকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। প্রতারণার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জাপানে থাকেন। পূর্বেই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ঢাকার বনানী থানার পুলিশ।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে আরও একবার নিলামের দরপত্র প্রকাশ করে ব্যাংক। ঋণের দায়ে শেরপুরে কোম্পানিটির মোট ৫০৮ শতাংশ জমি, জামালপুরে ২২৪ শতাংশ জমি এবং এর ওপর নির্মিত যাবতীয় স্থাপনাও নিলামে বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও নিলাম হয়নি। যে কারণে বেসিক ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকাও প্রদান হয়নি।

এই ঋণের গ্যারান্টার এবং বন্ধকদাতারা ছিলেন কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি গালিব, চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, পরিচালক সজন কুমার বসাক এবং অমিতাভ ভৌমিক। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিব ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ রেখে কোম্পানি থেকে বিদায় নেন এবং দেশ ত্যাগ করেন।

তাই বেসিক ব্যাংক কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করেছে। আর আদালতের রায় অনুযায়ী ঋণের টাকা উদ্ধারে কোম্পানিটির বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গালিবসহ পুরোনো মালিকপক্ষ দেশান্তরী হওয়ায় দেশের প্রথম বৃহৎ রাইস ব্র্যান অয়েল ‘স্পন্দন’ এর উৎপাদন বন্ধ হয়। প্রায় ৬ বছর উৎপাদন বন্ধ থাকার পরে নতুন পরিচালকরা কোম্পানির উৎপাদন ফের চালু করে।

উৎপাদিত তেল রপ্তানিতে গত বছরের ২০ জুলাই জাপানিজ কোম্পানি বি-বর্ন কোং লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এমারেল্ড অয়েলের পক্ষে স্বাক্ষর করেন কোম্পানির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম এবং বি বর্ন কোং-এর পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী শিঙ্গো মিয়াউচি।

তেল রপ্তানি সম্পর্কে সেদিন এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, তেল রপ্তানিতে চুক্তি করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব অনুমোদনের পর তেল রপ্তানি শুরু হবে। আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে রপ্তানি শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা এখনো হয়নি।

আরবি/জেআই

Link copied!