ঢাকা রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয়বিমুখ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম

মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয়বিমুখ মানুষ

ছবি: সংগৃহীত

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি ইতিবাচক ধারায় ছিল। তবে গত নভেম্বরে এসে হঠাৎ এ খাতে বিনিয়োগ কমিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ক্রয় বা নবায়নের চেয়ে বেশি অংকে ভাঙা হয়েছে সঞ্চয়পত্র। ফলে এ খাত থেকে সরকার ঋণ না পেয়ে উল্টো আগের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। 

তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে নিট বিক্রি ৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা ঋণাত্মক হয়েছে। অর্থাৎ ওই মাসে কেনার চেয়ে ভাঙানোর চাপ বেশি ছিল। ফলে নিট বিক্রি বড় অংকে ঋণাত্মক হয়ে যায়। সাধারণত ভাঙানোর চেয়ে কেনার পরিমাণ বেশি হলে তাকে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বিবেচনা করা হয়। এটাকে ঋণ বিক্রি ধরা হয়। আর কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়ে গেলে সরকারের ঋণ পরিশোধ হয়। এটাকে নিট বিক্রি ঋণাত্মক বলা হয়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত নভেম্বরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী সঞ্চয় করতে পারেনি। আবার গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। 

এ ছাড়া ব্যাংক আমানত ও সরকারের বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ব্যাংক ও বিল-বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে সুদহার বাড়ানোর কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগামীতে আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। 

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল এক হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের নিট বিক্রির ঋণাত্মক অঙ্ক বেড়েছে এক হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দুই হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, দ্বিতীয় মাস আগস্টে দুই হাজার ৩৬ কোটি, তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে চার হাজার ১০৯ কোটি এবং অক্টোবরে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ৩ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। 

নভেম্বরে নিট বিক্রি নেতিবাচক হলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) নিট বিক্রি ইতিবাচক রয়েছে। এ সময় নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় নিট বিক্রি ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মানুষের গড় আয় কমে গেছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা যে পরিমাণ আয় রাখার কথা তা রাখতে পারছে না। আরও অনেকে জমানো টাকা ভেঙে ফেলছেন তাদের দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য। 

অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যারা নামে-বেনামে একসময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। সবমিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’ 

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তিন বছরমেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফা সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাব্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ রয়েছে। 

পাঁচ বছরমেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ হবে। 

বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অন্যদিকে একই মেয়াদের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ হবে। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

বর্তমানে এ স্কিমে সুদহার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ রয়েছে। এ ছাড়া তিন বছরমেয়াদি ডাকঘর স্থায়ী আমানতে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। 

এদিকে বর্তমানে ব্যাংকগুলো সাধারণত স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দেয়। তবে তারল্যসংকটে থাকা কিছু ব্যাংক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ পান গ্রাহক। 

অর্থাৎ আগে ব্যাংকের আমানত এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি থাকলেও বর্তমানে সেটা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে সঞ্চয়পত্রের বিষয়ে নতুন এক নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তির দিনেই গ্রাহককে আসলসহ মুনাফার টাকা ফেরত দিতে হবে। 

জানা গেছে, এতদিন সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আসল টাকা তুলতে সময়ক্ষেপণসহ নানা ভোগান্তির শিকার হতেন গ্রাহক। নতুন এ নির্দেশনার ফলে এ ভোগান্তি দূর হলো। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশি মেরিনার, পাইলট ও কেবিন ক্রুরা এতদিন ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন না, এখন তাদেরও এই বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

এভাবে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডসহ সঞ্চয় অধিদপ্তর পরিচালিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগসমূহ মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি হয়েছে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!