ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঋণখেলাপির তালিকায় গোপন রাখা হয় শীর্ষ ৬ গ্রুপের নাম

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ০১:৫৮ এএম

ঋণখেলাপির তালিকায় গোপন রাখা হয় শীর্ষ ৬ গ্রুপের নাম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেদার ঋণ পেয়েছে। ঋণ পরিশোধ না করতে দেদার ছাড়ও পেয়েছে। ফলে গত দেড় দশক ধরে খেলাপির খাতা খুলেনি বেক্সিমকো এবং এস আলম গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত আগস্টে সরকারের পালাবদলের পর ব্যাংক খাতের খেলাপির নতুন তথ্য এসেছে সামনে। এতে দেখা যায়, পাঁচ ব্যাংকে খেলাপির শীর্ষ ১০ শিল্পগোষ্ঠীর কাছে পাওনা প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। এ তালিকায় আছে পুরোনো খেলাপি অ্যানোনটেক্স, ক্রিসেন্ট ও রতনপুর গ্রুপের নাম। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপ আর অপরিচিত রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রানকা গ্রুপের নামও। নরসিংদীর স্বল্প পরিচিত জাকিয়া গ্রুপ আছে তালিকায় সাত নম্বরে। মাত্র দুই বছর আগেও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার খেলাপি গ্রুপের যে তালিকা সংসদে প্রকাশ করে, তাতে ছয়টি গ্রুপের নাম ছিল না। এবার জানা যাক, কোন কোন ব্যাংক বাছবিচারহীনভাবে উদার হস্তে এসব ঋণ দিয়েছে। তার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এ ছাড়া রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেগুলোর মোট ১৯ হাজার ২৮৪ কোটি ঋণের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা খেলাপির তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ ব্যক্তি ও কোম্পানি বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এর দেড় বছরের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের নতুন প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্য ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তালিকা তৈরি করেছে, সেটির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর ওই তালিকার ফারাক অনেক। আগের তালিকা বেক্সিমকো এবং এস আলম গ্রুপের নাম ছিল না।

বর্তমান তালিকায় সাবেক অর্থমন্ত্রীর প্রকাশ করা মাইশা, রিমেক্স ফুটওয়্যার, এফএমসির সিএলসি পাওয়ার ও ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টের নাম রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের পর আসল ঘটনা সামনে আসছে। কারণ, এসব গ্রুপ বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে। বড় ঋণ গ্রহীতাদের পুনঃতফসিলের ছাড় সুবিধার পরও অনেক কোম্পানি কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের খেলাপি দেখাত না। সঠিক তথ্যও বাংলাদেশ ব্যাংকে দিত না।

আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রভাবশালীদের চাপে বিভিন্ন সময় এসব ব্যাংকে পরিদর্শন দলও পাঠাত না। এখন ব্যাংকগুলোয় সেসব গ্রুপের প্রভাব না থাকায় এবং অনেক নতুন পর্ষদ আসায় বেক্সিমকো ও এস আলমের মতো বড় গ্রুপের নিজেদের কোম্পানির নামে কিংবা অন্য কোনো কোম্পানির নাম দিয়ে নেওয়া ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে।

মূলত সরকারের পালাবদলে নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ তদারকির অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ‘স্পেশাল মনিটরিং সেল’ গঠন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একজন ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এটির প্রধান করা হয়। এ সেল ১০০ কোটি টাকার ওপরের খেলাপি ঋণের তথ্য খুঁজে বের করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ১০০ কোটি টাকা এবং তদুর্ধ্ব স্থিতির ‘শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ও ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কমিয়ে আনতে’ স্পেশাল মনিটরিং টিম কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে বক্তব্য দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মূলত ১০০ কোটি টাকার ওপর খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ৩৬টি ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে চেয়েছে সামনে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে যেসব ব্যাংকে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ বেশি সেগুলোয় যাতে নতুন করে আবার ‘শ্রেণিকৃত’ (খেলাপি) না সেজন্য নিবিড় তদারক করে নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় নিশ্চিত করতে পরামর্শ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

বৃহৎ শিল্প গ্রুপের কাছ ঋণ আদায়ে আইনগত জটিলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আদালতের স্থগিতাদেশ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব, ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছা প্রভৃতি কারণে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও কঠিন হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে আদায় হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, খেলাপি ঋণ আদায়ে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করা এবং প্রয়োজনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি ব্যবহারে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এত দিন কাগজপত্রে খেলাপি না হলেও এবার তালিকার শীর্ষ নাম বেক্সিমকো গ্রুপের। এ গ্রুপের শিল্পপার্কের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির তথ্য বলছে, গ্রুপটির মোট ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ২৩ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই এখন খেলাপি।

অর্থাৎ কোনো একক গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও ননফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু সীমার চেয়ে সাড়ে ৮০০ গুণ বেশি ঋণ দেওয়া হয় বেক্সিমকো গ্রুপকে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী আরেক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ। গত দেড় দশকে এ গ্রুপের নামও কখনো খেলাপির তালিকায় ওঠেনি। গ্রুপটির ১০০ কোটি টাকার ওপর মোট খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বেসরকারি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক ইউনিয়নের পর্ষদ এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপান পরিচালক মো. সাইফুল আলমের (এস আলম) পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

জনতা ব্যাংক থেকে দেদার অর্থ নিয়ে নয়ছয় করা আলোচিত পোশাক খাতের অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। গ্রুপের ১৯টি কোম্পানির অ্যাকাউন্টের খেলাপি ১০০ কোটির ওপরে। ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে এ ব্যাংক থেকে এ গ্রুপের কোম্পানি গ্যালাক্সি সোয়েটার্স অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িংয়ের নামে প্রথম ঋণ পায়, যেটির পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি টাকা। প্রথম দিকে ঋণের টাকা পরিশোধও করেন তিনি। পরে ঋণ বাড়তে থাকে এ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে, যেগুলোর প্রায় সবই পোশাক ও বস্ত্র খাতের।

একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করলেও এ গ্রুপের কোম্পানিকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেয়নি জনতা ব্যাংক।

বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান দুর্দশার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হলো আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আসলামুল হকের কোম্পানি মাইশা গ্রুপকে দেদার দেওয়া বিপুল ঋণ। সবশেষ হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।

আসলামুল হকের মৃত্যুর পর ২০২১ সালে ব্যবসার হাল ধরে তার স্ত্রী মাকসুদা হক দায়ের সব টাকা দিতে পারবেন না বলে বিভিন্ন ব্যাংককে জানিয়ে দেন।

এর মধ্যে অন্যতম আরেকটি গ্রুপ চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ মেরামতকারী কোম্পানি এফএমসি গ্রুপ। এটির আরও অন্য খাতে ব্যবসা রয়েছে। এটির চেয়ারম্যান ইয়াসিন চৌধুরী। ন্যাশনাল ব্যাংকে এফএমসি গ্রুপের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এফএমসির ডকইয়ার্ড কোম্পানিটিকে ‘ইচ্ছাকৃত’ খেলাপি গ্রহীতা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকটি। অর্থঋণ আদালতে মামলাও হয়েছে। শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা চামড়া খাতের ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, ইস্পাত খাতের ব্যবসা থাকা রতনপুর গ্রুপ এবং তৈরি পোশাক খাতের রানকা গ্রুপের খেলাপি ঋণ ফুলে ফেঁপে উঠেছে জনতা ব্যাংকে। অপরদিকে বস্ত্র খাতের নরসিংদীভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী জাকিয়া গ্রুপকে ঋণ দিয়ে চাপে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক ব্যাংক অগ্রণী।

আরবি/জেডআর

Link copied!