ঢাকা শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সিইও নেই ১০ বিমা কোম্পানিতে

রহিম শেখ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের বিমা খাতে এখনো রয়েছে ইমেজ সংকট। নানা কারণে খাতটির বিকাশ হয়নি আশানুরূপ। এরপরও একের পর এক নতুন বিমা কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এসব বিমা কোম্পানির বেশির ভাগই ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে নেই যোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। পুরোনো কয়েকটি কোম্পানিরও একই দশা। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে কার্যক্রম। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত সিইও দিয়ে চলছে কোম্পানির কার্যক্রম। দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা এমন অন্তত ১০টি লাইফ ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নেই। সিইও নিয়োগে যে আইন আছে তা মানছে না কোম্পানিগুলো। ফলে জরিমানা গুনতে হচ্ছে এসব কোম্পানিকে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমা কোম্পানিগুলো দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণ করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। প্রতিষ্ঠানটি বিমা কোম্পানির উন্নয়নে যেমন কাজ করে তেমনি কোম্পানিগুলোর জনবল নিয়োগে, বিশেষ করে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) নিয়োগ অনুমোদনের কাজটি গুরুত্বের সঙ্গে করে। তবে ১০টি কোম্পানি সিইও নিয়োগে আইডিআরএর নিয়ম মানছে না। প্রকারান্তরে তারা কর্তৃপক্ষকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখাচ্ছে।

জানা গেছে, আইডিআরএর করা আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ তিন০ মাস বা সর্বসাকল্যে ছয় মাসের বেশি খালি রাখার সুযোগ নেই। সেখানে বছরের পর বছর মুখ্য নির্বাহীর পদটি ভারপ্রাপ্ত বা চলতি দায়িত্ব দিয়ে চালালেও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না সংস্থাটি। উল্টো ‘যোগ্য’ সিইও’র অভাবের দোহাই দিয়ে নিজেদের করা আইন প্রতিনিয়ত নিজেরাই ভাঙছে আইডিআরএ।

সিইও নিয়োগে আইন না মানা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো হলো- গার্ডিয়ান লাইফ, আকিজ তাকাফুল লাইফ, সোনালি লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফ, যমুনা লাইফ, সান লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ ও বায়রা লাইফ। এ ছাড়া দুটি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি হচ্ছেÑ কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স ও রুপালি ইন্স্যুরেন্স।

জানা গেছে, প্রায় চার বছর ধরে সিইও (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা) ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দেশের চতুর্থ প্রজন্মের জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান গার্ডিয়ান লাইফ। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সিইও পদটি শূন্য, যা বিমা আইন-২০১০ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই আইনের ৮০ ধারা অনুযায়ী, কোনো বিমা কোম্পানিকে তিন মাসের মধ্যে সিইও নিয়োগ করতে হবে। যদি বিশেষ কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্ভব না হয়, তবে আরও তিন মাস সময় দেওয়া হয়। তবে, ছয় মাসের বেশি সিইও পদটি খালি রাখা যাবে না। 

এ পরিস্থিতিতে, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গার্ডিয়ান লাইফ ইনস্যুরেন্সকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন সিইও নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে আইন লঙ্ঘনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ওপর পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করেছে। আইডিআরএ সূত্রমতে, গার্ডিয়ান লাইফের শেষ সিইও ছিলেন এম এম মনিরুল আলম, যিনি ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এরপর এখন পর্যন্ত নতুন সিইও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে সিএফও শেখ রাকিবুল করিম ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্সও চলছে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে। ২০২১ সালের ২৭ জুন কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন মোহম্মদ আলমগীর চৌধুরী। প্রায় সাড়ে তিন বছর তিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আলমগীর চৌধুরীকে পূর্ণাঙ্গ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেও গত ১৫ জানুয়ারি আইডিআরএ তার আবেদন না-মঞ্জুর করে। 

এদিকে ২০২০ সালের ২৬ জুন এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সোনালি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় মীর রাশেদ বিন আমানকে। সাড়ে ৩ বছর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করার পর অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। রাশেদ বিন আমানের দায়িত্বকালে সোনালি লাইফের একাধিক অনুষ্ঠানে আইডিআরএর তৎকালীন চেয়ারম্যান সশরীরে উপস্থিত হয়ে তার এবং কোম্পানির প্রশংসা করেছেন।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন পরিপালন না করায় মীর রাশেদ বীন আমান বা সোনালি লাইফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সহযোগিতা করেছে আইডিআরএ। এতে একদিকে যেমন তারা নিজেদের তৈরি করা আইন লঙ্ঘন করেছে; অন্যদিকে অন্য কোম্পানিগুলোকে আইন পরিপালনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। নিয়ম অনুযায়ী, তিনিও ভারপ্রাপ্ত সিইও হিসেবে ছয় মাস পার করেছেন। 

মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্সও চলছে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে। চলতি বছরের আগস্টে এসকে. আব্দুর রশিদকে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদ ছয় মাস হতে চললেও পূর্ণাঙ্গ সিইও নিয়োগের কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। 

গত বছরের ২৯ আগস্ট থেকে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) চলতি দায়িত্ব পালন করা ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি অব্যাহতি দিয়েছে কোম্পানি। ফলে সিইও শূন্য রয়েছে কোম্পানিটি। তবে যমুনা লাইফের ওয়েবসাইটে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে এখনো বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলের নাম রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এখনো তিনি সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন।

বায়রা লাইফও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগে নিয়ম মানছে না। এই কোম্পানিতে বর্তমানে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানিটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার ও কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মামুন খান। তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদ ছয় মাস অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা।
হোমল্যান্ড লাইফে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ আবদুল মতিন। তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদ ইতিমধ্যে তিন মাস অতিক্রম করেছে। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থবিরতা কাটিয়ে কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রমে গতি এসেছে। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোম্পানির বোর্ড আবদুল মতিনকে পূর্ণাঙ্গ সিইও নিয়োগ দিতে ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।

দুই বছর ধরে সিইও (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা) ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ড্রাগন গ্রুপের প্রয়াত কর্ণধার মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের (ওসি কুদ্দুস) মালিকানাধীন রুপালি ইন্সু্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সিইও পদটি শূন্য রয়েছে, যা বিমা আইন-২০১০ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ পরিস্থিতিতে, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) রুপালি ইন্স্যুরেন্সকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন সিইও নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। 

গত ২৯ জানুয়ারি আইডিআরএর পরিচালক সালেহীন তানভীর গাজী স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত চিঠি রুপালি ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘২০২৩ সাল থেকে সিইও পদটি শূন্য থাকার কারণে জরিমানা করা হয়েছে। আইডিআরএ তাদের ১৭৮তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত সিইও ফাওজিয়া কামরুন তানিয়া বলেন, সিইও পদে আবেদনের প্রস্তুতি চলছে। আমি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। সিইও হিসেবে আবেদনের জন্য সেখানকার কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন, যা পেলেই আবেদন করব। তবে কিছু সময় লাগবে। 

এদিকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইসঙ্গে কোম্পানিটিকে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।